প্রশিক্ষণ ভাতায় সার উৎপাদন শুরু, তানজিলার এখন মাসে বিক্রি ৫০ হাজার টাকা

কালীগঞ্জ উপজেলার কৃষি কার্যালয়ের কাছে খামারটির অবস্থান
ছবি: সংগৃহীত

দুটির মধ্যে যেকোনো একটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ ছিল। সেলাই বা কেঁচো দিয়ে জৈব সার (ভার্মি কম্পোস্ট) তৈরি। তানজিলা আক্তার বেছে নেন ‘ভার্মি কম্পোস্ট’। কিন্তু কেন? তানজিলা বলেন, ‘আগে থেকেই সেলাই জানতাম। তাই নতুন কিছু শিখতে চেয়েছিলাম।’

২১ বছর বয়সী তানজিলার বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায়। তিনি ঝিনাইদহের ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা ইন ল্যাবরেটরি মেডিসিনে তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন।

শিক্ষার্থী অবস্থায় প্রশিক্ষণ নিয়ে বসে থাকেননি তানজিলা। তিনি কেঁচো সার তৈরির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতে বসেই উৎপাদন শুরু করেন। সার বিক্রি করে শুরু করেন আয়।

পরে বড় ভাই শাকিল হোসাইনকে (২২) সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘উদ্যোক্তা অ্যাগ্রো ফার্ম’। কালীগঞ্জ উপজেলার কৃষি কার্যালয়ের কাছে ২৪ শতক জমির ওপর খামারটির অবস্থান।

এখন খামারে সার উৎপাদনের দিকটি দেখেন তানজিলা। অনলাইনে সার বিক্রির দিকটি দেখেন শাকিল।

তানজিলা জানান, তিনি ২০১৮ সালে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপজেলা পর্যায়ে নারীদের আয়বর্ধক (আইজিএ) প্রশিক্ষণ প্রকল্পের প্রথম ব্যাচে তিন মাস মেয়াদে (৬০ কর্মদিবস) প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ ভাতা বাবদ ছয় হাজার টাকা পান। এখান থেকে দুই হাজার টাকা খরচ করে বাড়িতে কেঁচো সার তৈরি করেন।

কেঁচো সার তৈরির প্রধান উপকরণ কেঁচো। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, কেঁচো সার মাটির উর্বরতা বাড়ায়। মাটির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ায়। জমিতে যেসব রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়, তার ভালো কার্যকারিতা পেতেও কেঁচো সারের মতো জৈব সার ব্যবহার করতে হয়।

শুরুতে এক কেজি কেঁচো দিয়ে সার বানানো শুরু করেন তানজিলা। তিনি এই কেঁচো দিয়ে ৪০ থেকে ৫০ কেজির মতো সার বানাতে পেরেছিলেন। পরে এই সার অনলাইনে বিক্রি করেন।

তানজিলা বলেন, বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় তিন বছর আগে সার উৎপাদনের কার্যক্রম বাড়ির আঙিনা থেকে বড় পরিসরের খামারে নেন। এখন খামারে ১০০ কেজির মতো কেঁচো আছে। এই কেঁচো দিয়ে মাসে চার টনের মতো সার উৎপাদিত হয়। সার বিক্রি থেকে মাসে আয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা।

তানজিলার বাবা নুরুল ইসলাম, মা পারভিনা বানু। দুই ভাই–বোনের মধ্যে তানজিলা ছোট। বাবার চায়ের দোকান আছে। তানজিলা জানান, তিনি তাঁর বাবা ও ভাইয়ের সহায়তায় খামারটি বড় পরিসরে নিতে পেরেছেন। কারণ, তাঁরা শুরু থেকেই নানাভাবে সহায়তা করে আসছেন।

ঝিনাইদহের ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা ইন ল্যাবরেটরি মেডিসিনে তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন তানজিলা

তানজিলা বলেন, বাড়িতে সার উৎপাদন শুরুর এক বছর পর বড় পরিসরের কাজে হাত দেন। তখন টাকার প্রয়োজন ছিল। তাঁর বাবা কৃষি ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা ঋণ এনে তাঁকে দেন।

শাকিল বলেন, কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে জমি বা সম্পদ জামানত রাখতে হয়। বাবার নামে জমি আছে। তিনি জমি জামানত রেখে ঋণ নেন। সার বিক্রির আয় থেকে ধীরে ধীরে এই ঋণ শোধ করা হয়েছে। এখন বাবার মাধ্যমে নতুন করে আরও দেড় লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে।

তানজিলা জানান, খামারের জন্য এখন বছরে ২৫ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। বাড়িতেও ছোট পরিসরে কাজ চলে। কাজে সহায়তার জন্য একজন লোক রাখা হয়েছে।

সার বিক্রি সম্পর্কে শাকিল বলেন, ধান ও সবজিচাষিরা এই সার কেনেন। যাঁরা বাগান করেন, তাঁরাও নেন। ধানখেতে বছরে একবার ভার্মি কম্পোস্ট দিতে হয়। প্রতি শতক জমিতে তিন থেকে পাঁচ কেজি সার লাগে। সবজিখেতে প্রতিবার সবজি তোলার পর ভার্মি কম্পোস্ট দিতে হয়। জমি উর্বর না হলে সার বেশি লাগে। এই সার অনলাইনে বেশি বিক্রি হয়।

আইজিএ প্রকল্পে ভার্মি কম্পোস্ট, মাশরুম ও মৌচাষের প্রশিক্ষক মো. আল আমিন বলেন, উপজেলা পর্যায়ে প্রকল্পের প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন তানজিলা। প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি ভাইকে সঙ্গে নিয়ে কেঁচো সার উৎপাদনে খামার গড়ে তোলেন। তাঁর ভাই শাকিলের কৃষি বিষয়ে ডিপ্লোমা আছে। তাঁরা সফলভাবে সার উৎপাদন করে তা বিক্রি করছেন। এতে তাঁদের ব্যবসার প্রসার ঘটেছে। পরিবারসহ সবার সহায়তা পেলে তানজিলার মতো অনেকে সফল উদ্যোক্তা হতে পারতেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘তানজিলাদের কেঁচো সার উৎপাদনের খামারটি দেখেছি। তাঁরা ভালো করছেন। তাঁরা অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারেন।’