বিশ্ববাজারে এলএনজি ও জ্বালানি তেলের চড়া দামের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের এমন সিদ্ধান্ত।
বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং জ্বালানি তেল আমদানি কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর পাশাপাশি ডিজেলচালিত সব বিদ্যুৎকেন্দ্রও আপাতত বন্ধ থাকবে। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমবে। আর বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণে সারা দেশে দিনে এক ঘণ্টা লোডশেডিং করবে বিদ্যুৎ বিভাগ। এক সপ্তাহ পর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সরকার নতুন সিদ্ধান্ত নেবে।
চলমান জ্বালানিসংকট পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে গতকাল সোমবার এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে অংশ নেওয়া দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারে এলএনজি ও জ্বালানি তেলের চড়া দামের পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পিত লোডশেডিং ও জ্বালানি সাশ্রয়ে সমাধান দেখছে সরকার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বিভিন্ন খাতে আমদানি কমানোরও পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর জ্বালানি খাতে ভর্তুকি লাগাম টানার কথা বলেছে অর্থ বিভাগ।
গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাবের কথা জানান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, ইউরোপের প্রতিটি দেশ জ্বালানি সাশ্রয়ে নানা কিছু করছে। কেউ কেউ দাম বাড়াচ্ছে। এশিয়ার দেশগুলোও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। এখন একটা সংকট সময় পার করছে গোটা বিশ্ব। আর এর মূল কারণ হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
সাশ্রয়ের কোনো বিকল্প ছিল কি না জানতে চাইলে নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, এখন এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া না হলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হবে। এ ছাড়া ডিজেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলে ইউনিটপ্রতি খরচ পড়ছে ৪০ টাকা। অথচ পাইকারি পর্যায়ের বিদ্যুৎ বিক্রি করা হয় সাড়ে পাঁচ টাকায়। এলএনজি কিনতে ইউনিটপ্রতি খরচ পড়বে ৩৯ টাকা। গ্রাহকের কাছে ১ ইউনিট গ্যাস বিক্রি করে গড়ে পাওয়া যায় সাড়ে ৯ টাকা। দাম স্থিতিশীল রেখে সরকারি ভর্তুকি সাশ্রয়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। আপাতত জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর চিন্তা নেই সরকারের।
কয়েক মাস ধরেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম চড়া। মাঝে এটি ব্যারেলপ্রতি ১৪০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেলেও এখন তা ১০০ ডলারের নিচে নেমেছে। যদিও দাম ৮০ ডলারের বেশি হলেই লোকসানে পড়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। জ্বালানি তেল আমদানি নিয়ে ডলারসংকটে পড়ে যায় বিপিসি। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম ৩৬ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ায় জুলাই থেকে খোলাবাজারে তা কেনা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে ৪ জুলাই থেকে দেশে শুরু হয় ভয়াবহ লোডশেডিং। টানা চার দিন পর ঈদের ছুটি শুরু হলে স্বস্তি পায় মানুষ। এখন আবার বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। এবার ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং করতে যাচ্ছে সরকার।
পরিকল্পিত লোডশেডিং শুরু আজ
সরকারি সিদ্ধান্ত বলছে, আজ মঙ্গলবার থেকে সারা দেশে এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং করা হবে। তবে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে শিল্প লোডশেডিংয়ের বাইরে থাকবে। বিতরণ কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের তালিকা দিতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার পর সর্বোচ্চ চাহিদার সময়ে এক ঘণ্টা লোডশেডিং করে ৯৭৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা যাবে বলে মনে করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ডিজেলচালিত সব বিদ্যুৎকেন্দ্র আপাতত বন্ধ রাখা হবে। গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা কমতে পারে। এতে করে দিনে সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি তৈরি হতে পারে। এক সপ্তাহ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এক ঘণ্টায় কাজ না হলে দুই ঘণ্টা করা হতে পারে লোডশেডিং।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দিনে দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এর সঙ্গে বিদেশ থেকে আমদানি করে আরও ৮৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হতো। এর মধ্যে ৫০ কোটি ঘনফুট আসে কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায়। আর বাকি ৩৫ কোটি ঘনফুট খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে কেনা হতো, যা আপাতত বন্ধ রয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে ২০ শতাংশ ডিজেলের ব্যবহার কমানোর চিন্তা করছে সরকার। বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে ১০ শতাংশ ডিজেল সাশ্রয় করা যাবে। বাকি ৯০ শতাংশ ব্যবহার করা হয় পরিবহনসহ অন্য খাতে। এসব খাত থেকে ১০ শতাংশ ব্যবহার কমাতে হবে। এর জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছে সরকার। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, সপ্তাহে এক দিন পেট্রলপাম্প বন্ধ রাখার প্রস্তাব এসেছে। পেট্রলপাম্প মালিক সমিতির সঙ্গে বৈঠক করে এ বিষয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেবে বিপিসি।
সপ্তাহে এক দিন পেট্রলপাম্প বন্ধের প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবে দেখছে বাংলাদেশ পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের সভাপতি নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এতে কিছুটা হলেও জ্বালানি তেল সাশ্রয় হবে। তবে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে অনেকে বন্ধের আগের দিন বেশি করে জ্বালানি তেল কিনতে পারেন। তা ছাড়া যাঁরা রাইড শেয়ারিং করেন, তাঁরা বিপাকে পড়তে পারেন বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, রোববার ও বৃহস্পতিবার পেট্রলপাম্প বন্ধ না রাখলে ভালো হয়।
রাত আটটায় শপিং মল বন্ধ
গত ২০ জুন থেকে সারা দেশে সব ধরনের আলোকসজ্জা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শপিং মল, দোকানপাট রাত আটটার মধ্যে বন্ধেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। মাঝে ঈদের কেনাকাটার জন্য ১ থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত শপিং মল ও দোকানপাট বন্ধের সময় রাত ১০টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। এরপর থেকে আবার রাত আটটায় এসব ব্যবসাকেন্দ্র বন্ধ করার সিদ্ধান্ত বহাল হয়েছে। এ বিষয়ে গতকাল বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, দোকান ও বিপণিবিতান বন্ধের বিষয়টি বিদ্যুৎ বিভাগ নজরদারি করবে। রাত আটটার মধ্যে বন্ধ করা না হলে বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে।
সরকারের প্রস্তাব মেনে রাত আটটার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ করা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে নিজেরাই রাত আটটার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ করেছি। মাঝখানে ঈদের সময় বাড়তি সময় নেওয়া হয়েছিল।’
দাম স্থিতিশীল রেখে সরকারি ভর্তুকি সাশ্রয়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। আপাতত জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর চিন্তা নেই সরকারের।নসরুল হামিদ, প্রতিমন্ত্রী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়
আরও প্রস্তাব
জ্বালানি সাশ্রয়ের বিষয়ে গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের আরও কিছু প্রস্তাবের কথা জানান নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, এসব প্রস্তাবের কিছু কিছু মন্ত্রিসভা বিভাগের সিদ্ধান্তের বিষয়। ওই বিভাগ থেকে এসব প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে। জ্বালানি তেল সাশ্রয়ের ফলে কী পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি বিপিসি হিসাব–নিকাশ করে জানাবে।
প্রস্তাবের মধ্যে সরকারি অফিসের সময় দুই ঘণ্টা কমিয়ে আনার বিষয়টি বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রার্থনার সময়ের বাইরে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) বন্ধ রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে। সরকারি অফিসের এসি নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টিও আলোচনা হয়েছে। সরকারি গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে আনতে সব সভা ভার্চ্যুয়াল করার পরামর্শ এসেছে।
চলমান বিদ্যুৎ–সংকট মোকাবিলায় সরকারি অফিসের সময় কমিয়ে আনা হবে, নাকি বাসা থেকে অফিস করা হবে, তা শিগগিরই চূড়ান্ত হবে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের জানান, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে অফিস সময় সকাল ৯টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত করার প্রস্তাব এসেছে। কেউ কেউ নয়টা থেকে চারটা পর্যন্ত করার কথা বলেছেন। বাসা থেকে অফিস করার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘অফিসের সময় কমিয়ে আনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আমরা সব বিষয় বিশ্লেষণ করে সঠিক কাজটি করার চেষ্টা করব।’
সরকারি কর্মকর্তারা গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের অপব্যবহার যাতে না করতে পারেন, সে বিষয়েও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
সংকট মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া কিছু পদক্ষেপের বিষয়ে মতভিন্নতা রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর চেয়ে দাম বাড়ানো ভালো সমাধান হতে পারত। দাম বাড়ানো হলে ভোক্তাও ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতো। বিদ্যুৎ উৎপাদনও ধরে রাখা যেত। তবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম. তামিম প্রথম আলোকে বলেন, সারা বিশ্বই সংকটে। এক ঘণ্টা লোডশেডিং অযৌক্তিক নয়। ডলারের সংকট সব দেশে, সাশ্রয় করতেই হবে। তবে এর মধ্যে তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যাবে না। তাহলে লোডশেডিংয়ের ভোগান্তির সঙ্গে মূল্যস্ফীতি জনজীবনকে দুঃসহ করে তুলতে পারে।