‘যে গণতান্ত্রিক সমাজ আমাদের প্রত্যাশিত, সেখানে যথাযথ জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। কিন্তু বাস্তবে আমাদের সমাজে তা হয়নি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যে চর্চা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল, এখন তা নেই। এখন আছে দলীয় চর্চা।’ এমন মন্তব্য করেছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের ১১তম প্রয়াণদিবস উপলক্ষে আয়োজিত স্মারক বক্তৃতায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এই মন্তব্য করেন। ‘উত্তরসূরি: নুরজাহান-সারওয়ার মুরশিদ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ এই বক্তৃতার আয়োজন করে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সহায়তায়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
‘গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে অ্যাকাডেমিক অ্যাকটিভিজমের প্রাসঙ্গিকতা’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতায় বক্তা অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ভাষা ও স্বাধিকার আন্দোলনে জাতীয় চেতনা সৃষ্টি ও শিক্ষার বিস্তারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্রিয় ভূমিকা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে সংশ্লিষ্টতার বিষয়গুলো ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর উল্লেখ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তুলে ধরেন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধ সৃষ্টি করা। এই মূলবোধই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল চেতনা হিসেবে কাজ করেছে। শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যে এই উচ্চতর মূল্যবোধ সঞ্চারিত করেছেন।
খান সারওয়ার মুরশিদসহ প্রগতিশীল শিক্ষকেরা এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বলে স্মারক বক্তা উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনে গঠিত কমিটিতে খান সারওয়ার মুরশিদের সভাপতির ভূমিকার উল্লেখ করে বলেন, ঘটনাটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরপরই ছায়ানট, ক্রান্তির মতো সংগঠনগুলোর গড়ে ওঠা, পয়লা বৈশাখ পালনের মতো সাংস্কৃতিক কাজগুলো শুরু হয়েছিল। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এই আলোড়ন রাজনীতি ও জনমানসে জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
অধ্যাপক চৌধুরী খান সারওয়ার মুরশিদের সম্পাদিত নিউ ভ্যালুজ পত্রিকার ভূমিকা উল্লেখ করে বলেন, ‘এই পত্রিকা তখন আমরা কেমন সমাজ রাষ্ট্র সংস্কৃতি প্রত্যাশা করি, সে সম্পর্কে নতুন ভাবনাচিন্তাকে তুলে ধরেছিল।’ তিনি বলেন, ‘দেশে আমাদের প্রত্যাশিত মানের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ জন্য সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সামাজিক বিপ্লব করতে হবে।’
স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের মতো প্রগতিশীল চিন্তার শিক্ষকেরা গত শতকের পঞ্চাশ-ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে যে স্বাধিকারের চেতনা সৃষ্টি করেছিলেন, সেটিই আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে জানি। জাতীয় চেতনার সৃষ্টির পাশাপাশি শিক্ষকতায় যে উচ্চ মান তাঁরা তৈরি করেছিলেন, আজকের সময়ে তা অনুভব করা কঠিন। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের পক্ষে তা আরও কঠিন।’ জাতির ইতিহাসে তাঁদের ভূমিকা ভবিষ্যতের নাগরিকদের কাছে তুলে ধরতে এমন আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
নির্ধারিত আলোচক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, পাকিস্তান আমলে দেশ এক হলেও পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সংস্কৃতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। সাংস্কৃতিক অধিকার, স্বায়ত্তশাসন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যে বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা পালন করেছেন, তার গভীর তাৎপর্য রয়েছে।
লেখক–গবেষক হাসনাত আবদুল হাই তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘একাডেমিক অ্যাকটিভিজম’ শব্দটি অপরিচিত ছিল। অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ এটি প্রয়োগ করেছিলেন তাঁদের সমাজ, সংস্কৃতি, জাতীয়তাবোধ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক সক্রিয়তার বিষয়টি বর্ণনা করার জন্য। তিনি বলেন, শুধু শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকতা নয়, তিনি পত্রিকা প্রকাশসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৬৭ সালে রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত প্রচারে নিষেধাজ্ঞা এলে এর বিরুদ্ধে তিনি শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তখন সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলন পরস্পরকে প্রভাবিত করে একধারায় অগ্রসর হয়েছে।
সাবেক সচিব মুহাম্মদ আসাফ্উদ্দৌলাহ্ বলেন, খান সারওয়ার মুরশিদ ছিলেন পশ্চিমা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, সুরুচিসম্পন্ন অত্যন্ত পরিশীলিত আচরণের মানুষ। তিনি সমাজের যে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, বর্তমানে তার কিছুই অবশিষ্ট নেই।
অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই সম্প্রতি সরকারের শিক্ষানীতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি পূর্বানুমোদন নেওয়া আলোচনা নির্ধারিত দিনে অনুষ্ঠিত হতে না দেওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের মতো প্রতিষ্ঠানে আলোচনা করার মুক্ত পরিবেশ না থাকলে নাগরিক অধিকারের চর্চা কীভাবে এগিয়ে যাবে।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন উত্তরসূরির মহাসচিব শারমীন মুরশিদ, স্বাগত জানান এর পরিচালক মোস্তফা জামান।