বিশেষ কোনো দলকে ক্ষমতায় আনার জন্য আন্দোলন করেননি বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুল কাদের। আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বিপ্লব–পরবর্তী মতানৈক্য বিপ্লবকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তারুণ্য সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে। দেশে বাক্স্বাধীনতা ছিল না, গণতন্ত্র ছিল না। আমরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি।’
গতকাল রোববার বিকেলে ফেনী জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় আবদুল কাদের এ কথাগুলো বলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গতকাল ফেনীর পাশাপাশি মানিকগঞ্জ ও দিনাজপুরে ‘গণ-অভ্যুত্থানের প্রেরণায়, শহীদ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্র-নাগরিক মতবিনিময় সভা’ করেছে। ৮ সেপ্টেম্বর থেকে জেলায় জেলায় গিয়ে মতবিনিময় সভা করছেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কেরা।
বিগত সময়ে ফেনীর মানুষেরা কথা বলতে পারেননি উল্লেখ করে মতবিনিময় সভায় আবদুল কাদের বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসররা মানুষদের অনেকটা জিম্মি করে রেখেছিল। যেন বসবাস ছিল জেলখানায়। তিনি আরও বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে হঠাতে পারলেও দেশ সংস্কার এখনো হয়নি, সেটার অনেক বাকি। আগামীর বাংলাদেশ সুশাসনের বাংলাদেশ। দখলদারির রাজনীতিতে কুঠারাঘাত করতে হবে। ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক কোনো রাজনীতি থাকবে না। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকবে ছাত্রসংসদভিত্তিক। তারুণ্যের কোনো দল-মত নেই। তারা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চায়, সুশাসনের বাংলাদেশ চায়।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হামযা মাহমুদের সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন আন্দোলনে ফেনীর মহিপালে নিহত শিক্ষার্থী শ্রাবণের বাবা নেসার আহমেদ। তিনি ছেলের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। নেসার আহমেদ বলেন, ‘এই হত্যার বিচার কঠোরভাবে হওয়া চাই। আর কারও মায়ের বুক খালি না হোক।
আমার একমাত্র পুত্রসন্তান এ আন্দোলনে শহীদ হয়েছে। বিচার ছাড়া আমাদের চাওয়ার আর কিছু নেই।’
সভায় আন্দোলনে গিয়ে নিহত ইকরাম হোসেনের ভাই ইমরান হোসেনও বক্তব্য দেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক দলের প্রতিনিধিদের মধ্যে খালিদ হাসান, তাসনিয়া নওরিন, আলী আহমেদ আরাফ, মো. মহিউদ্দিন, জিয়া উদ্দিন আয়ান, মহিদুল ইসলাম প্রমুখ বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠান শেষে ফেনী জেলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে খোঁজ নেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে হওয়া মামলা নিয়ে একটি পক্ষ টাকার ব্যবসা শুরু করেছে বলে অভিযোগ করেছেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম। মানিকগঞ্জে আয়োজিত ছাত্র-জনতার মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, ‘নিহতের পরিবার থেকে দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে। বর্তমানে সেসব মামলায় টাকার ব্যবসা শুরু করেছে একটি পক্ষ। আপনি দেখতে পাবেন ওই মামলায় অনেক নির্দোষ মানুষের নাম দেওয়া হচ্ছে। আবার টাকা নিয়ে অপরাধীদের নাম কাটা হচ্ছে। এসব কাজ যে–ই করুক না কেন, আমাদের জায়গা থেকে এ বিষয়ে প্রতিবাদ করতে হবে।’
মানিকগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে আয়োজিত সভায় সারজিস আরও বলেন, ‘বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা অসংখ্য মানুষকে মিথ্যা মামলা দিয়েছেন; হাসিনার দোসররা অসংখ্য মানুষকে অন্যায়ভাবে জেলখানায় রেখেছিলেন। ডিবি অফিসে পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি করেছেন। আজকেও যদি কিছু মানুষ অন্য কোনো রূপে এইগুলো করে, তাহলে তা–ও আমরা সমর্থন করি না।’ তিনি বলেন, যত দিন দেশে স্থিতিশীল অবস্থা না আসে, রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কার না হয় এবং সুষ্ঠু একটি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত একটি সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত সব ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
এর আগে দুপুরে শিল্পকলা একাডেমিতে সারজিস আলমসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি দল মানিকগঞ্জে আন্দোলনে আহত ও নিহতদের পরিবারের সঙ্গে মতবিনিময় করে। ঢাকা থেকে আসা এই দলে আরও ছিলেন আবদুল্লাহ সালেহীন (ঢাবি), সামিয়া মাসুদ (ঢাবি), মুবাশ্বিরুজ্জামান হাসান মৃধা (ঢাবি), মেহরাব হোসেন (জাবি), মো. হৃদয় হোসেন (জবি), আদিনা খান (নিউ ক্যাসল আইন একাডেমি), খন্দকার রায়হান (ঢাকা কলেজ), কাজী ইসমাইল হোসেন (ঢাবি), কাজী জুবায়ের (এআইইউবি) প্রমুখ। পরে মানিকগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও সভা করেন সমন্বয়ক দলের সদস্যরা।
এ সভায় সারজিস বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব সদস্য সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং যাঁদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ (এভিডেন্স) আছে, আইনগতভাবে তদন্তের মাধ্যমে তাঁদের অবশ্যই বিচার হতে হবে। অন্যায় অন্যায়ই; কাজেই যে দোষী, তাঁর বিচার হতে হবে।
দিনাজপুরের মতবিনিময় সভায় কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘যাঁরা সমন্বয়ক পরিচয়ে কোনো প্রকার অপকর্মে লিপ্ত হবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমরা বহু আন্দোলন–সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। এই রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্বও আমাদের। এই মুহূর্তে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’
দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট মাঠে আয়োজিত সভায় তরিকুল ইসলাম আরও বলেন, বর্তমানে সমন্বয়কদের নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে একটি অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের লোকজন এখনো ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ব্যতীত বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোথাও কোনো সমন্বয়ক বা কমিটি নেই। ৫ আগস্টের আগে আন্দোলনের স্বার্থে আমরা অনেক জায়গায় কমিটি দিয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আর কোনো কমিটি দেওয়া হয়নি এবং হবে না। আপনারা যেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, যদি আবারও ডাক আসে, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা হাতে হাত রেখে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।’
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবু সাঈদ লিওন, সহসমন্বয়ক মুনঈম ইসলাম, এসআই শাহিন, সজিব ইসলাম, মিশু আলী সুহাস, রেদওয়ান ইসলাম, রংপুর বিভাগীয় সমন্বয়ক রকিব মাসুদ, সদস্য রিফাত ইসলাম। দিনাজপুরে আন্দোলনে নিহত রবিউল ইসলামের স্বজনের পাশাপাশি কয়েকজন আহত শিক্ষার্থীও সভায় উপস্থিত ছিলেন।
সভায় আরেক সমন্বয়ক আবু সাঈদ বলেন, ‘আমাদের নয়া রাজনীতির বন্দোবস্ত করতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা শিক্ষার্থী। জনমানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করতে চাই আমরা। আমরা শিক্ষাসহ দেশের প্রতিটি সেক্টরকে রাজনৈতিক শৃঙ্খল থেকে বের করে আনতে চাই।’
এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টায় দিনাজপুর হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয় মিলনায়তনে মতবিনিময় সভা করেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কেরা।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন প্রতিনিধি, ফেনী, মানিকগঞ্জ ও দিনাজপুর]