‘আমার বাচ্চাদের আমি বিল্লু বলি। আমার তিনটা বিল্লু ছিল। একটা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। প্রিয়াংকা। আমার আদরের বিল্লু। শান্ত। মায়াবী। ফুলের মতো সুন্দর। আল্লাহ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে’—ফেসবুকে কথাগুলো লিখেছেন গোলাম রহমান।
প্রিয়াংকার পুরো নাম সেতারা রহমান। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল সে। ২৫ জুলাই দিবাগত রাত ১টার দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।
গোলাম রহমান বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। কুমিল্লায় পারিবারিক কবরস্থানে সেতারাকে দাফন করা হয়েছে। কবরস্থানের প্রথম কবরটিই তার। আগামীকাল শুক্রবার কুমিল্লা থেকে ঢাকায় ফিরবেন গোলাম রহমান।
আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে কথা হয় গোলাম রহমানের সঙ্গে। জানালেন, সেতারা মারা যাওয়ার পর থেকেই তাঁর কলেজ পড়ুয়া আরেক মেয়ে বলছে, বোনকে ছাড়া সে থাকতে পারছে না। সেতারাকে সে খুব ভালোবাসত। সেতারার ছোট ভাইয়ের বয়স চার বছর।
গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ২২ জুলাই সেতারার জ্বর এলে জরুরিভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হয়। এক ঘণ্টার মধ্যেই জানা যায় তার ডেঙ্গু হয়েছে। তারপর দু-একটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে শয্যা খালি পাওয়া যায়নি। তাই রাজধানীর শাহজাহানপুরে বাসার কাছেই প্রশান্তি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক লিমিটেডে (মালিবাগ মোড়ে) সেতারাকে ভর্তি করা হয়।
গোলাম রহমান বলেন, ‘ভর্তির আগে বারবার জানতে চেয়েছিলাম ডেঙ্গুর চিকিৎসায় হাসপাতালটিতে সব ব্যবস্থা আছে কি না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বারবার আশ্বাস দিয়েছিল, তাদের সব ব্যবস্থা আছে। তবে মেয়ের অবস্থা বেশি খারাপ হলে তখন জানায় যে হাসপাতালের নিজস্ব কার্ডিওলজিস্ট নেই। বাইরে থেকে কার্ডিওলজিস্ট আনার কথাও জানিয়েছিল। কিন্তু মেয়ের অবস্থা খুব বেশি খারাপ হলে তাকে বাধ্য হয়ে লাইফ সাপোর্ট দিয়েই ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাই। মেয়েকে ওই হাসপাতালে নিতে এক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। ততক্ষণে মেয়ে প্রায় অচেতন হয়ে গেছে। আবোলতাবোল বকছে।’
ইউনাইটেড হাসপাতালে পৌঁছানোর পর সেখানের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সেতারাকে দেখে দ্রুত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করেন। গোলাম রহমান বললেন, তখনই চিকিৎসক জানিয়ে দিয়েছিলেন, সেতারার অবস্থা ভালো না। আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। তবে তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন সেতারাকে বাঁচিয়ে তুলতে। একটু পরেই চিকিৎসক এসে জানিয়েছিলেন, সেতারা শ্বাস নিতে পারছে না। তারপর চিকিৎসক আবার এসে জানান, সে মারা গেছে।
গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশান্তি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যদি আগেই জানিয়ে দিত যে সেখানে সব ব্যবস্থা নেই, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি অন্য রকম হতো। চিকিৎসায় কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না অথবা রোগীর অবস্থা তো আমরা বুঝতে পারব না। প্রথম তিন দিন মেয়ে বমি করেছে। জ্বর ছিল। ডেঙ্গু হলে তো এমন হবেই। তবে শেষ মুহূর্তে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের কার্ডিওলজিস্ট নেই। ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তো কিছুই করার ছিল না। আমরা শেষ সময়ে সেখানে যাই।’
গোলাম রহমান বলেন, ডেঙ্গু রোগীর অবস্থা যেকোনো মুহূর্তে খারাপ হয়ে যেতে পারে, এটা প্রশান্তি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অজানা থাকার কথা নয়। তারা রোগীর স্বজনদের আগেই তাদের সীমাবদ্ধতার কথা জানাতে পারত। তা না করে শুধু ব্যবসার জন্য রোগী ধরে রাখা খুবই দুঃখজনক।
গোলাম রহমান পরিবার নিয়ে শাহজাহানপুরে থাকেন। তিনি বললেন, এই এলাকা ডেঙ্গুর রেড জোন বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। দুই বছর আগে তাঁর মা ও বোনেরও ডেঙ্গু হয়েছিল। গোলাম রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মশা মারার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। সিটি করপোরেশন সে দায়িত্ব পালন করলে তো আর ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি হতো না।’
সেতারা খুব শান্ত ছিল বলে জানালেন গোলাম রহমান। বললেন, ‘সে ঘুরতে পছন্দ করত। মারা যাওয়ার আগের সপ্তাহেই চুলে প্রথম দুই বেণি করে ছবি তুলেছিল। স্কুল কামাই দিতে চাইত না। পড়ার টেবিলটা তেমনি আছে, শুধু মেয়েটাই নেই। মেনে নিতে পারছি না, মনে হয় বাচ্চাটা আমার পাশেই আছে।’