মনুষ্যবিহীন এ আকাশযান কেনার জন্য তুরস্কের সঙ্গে সম্প্রতি চুক্তি করা হয়েছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেন যে ড্রোন ব্যবহার করে রুশ বাহিনীকে বিপাকে ফেলেছে, তুরস্কের তৈরি সেই বাইরাকটার টিবি২ ড্রোন কিনছে বাংলাদেশ।
এ ড্রোন কেনার জন্য বাংলাদেশ সম্প্রতি চুক্তি করেছে বলে ঢাকায় নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ড্রোন বাইরাকটার টিবি২–এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাইকার টেকনোলজির সঙ্গে বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনী সম্প্রতি চুক্তি সই করেছে।
এর আগে গত বছর তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মসউদ মান্নান ওই দেশের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদুলুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তুরস্কের তৈরি ড্রোন আন্তর্জাতিক মানের। তাই আমরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর চাহিদা মাথায় রেখে ভবিষ্যতে আধুনিক সরঞ্জাম কেনার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারি।’
তবে তুরস্ক থেকে ড্রোন কেনার বিষয়ে সর্বশেষ অগ্রগতির বিষয়ে গত রাতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে টেলিফোনে জানতে চাইলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মসউদ মান্নান এ নিয়ে কথা বলতে অপারগতা জানান।
কূটনৈতিক সূত্র থেকে জানা গেছে, এর আগে দুই দেশের বিদ্যমান প্রতিরক্ষা সহযোগিতার আওতায় তুরস্ক নির্মিত মাইন থেকে সুরক্ষাকারী যান, সাঁজোয়া যান এবং বহুমাত্রিক রকেট প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিনেছে বাংলাদেশ। গত বছর বাংলাদেশের কাছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত কামানের গোলা বিক্রির বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি সই হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের কাছে সামরিক হেলিকপ্টার ও ট্যাংক বিক্রিতে আগ্রহী তুরস্ক।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত সাভাসগলু বাংলাদেশ সফর করেন। তখন তিনি বাংলাদেশের কাছে সমরাস্ত্র বিক্রি করতে তুরস্কের আগ্রহের বিষয়টি জনসমক্ষে আনেন।
বাইরাকটার টিবি২ ড্রোন এর আগে লিবিয়া, সিরিয়া এবং আজারবাইজান–আর্মেনিয়ার যুদ্ধে সফল ব্যবহারের কারণে আলোচনায় এসেছিল। সর্বশেষ রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ে এ ড্রোনের ভূমিকা সমর বিশ্লেষকদের নজর কেড়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে থাকে, এমন একটি ওয়েবসাইট মিডলইস্টআইয়ের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাইরাকটার টিবি২ ড্রোনে কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি গত এপ্রিলে ওই ড্রোন রাশিয়ার ভূখণ্ডে গিয়ে দুটি তেলের ডিপোতে হামলা চালিয়েছিল। ওই হামলা রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই তুরস্কের কাছ থেকে এ ড্রোন কেনার প্রক্রিয়া শুরু করে ইউক্রেন সরকার। বিশেষ করে ২০১৯ সাল থেকে অন্তত ৩৬টি বাইরাকটার টিবি২ কিনেছে ইউক্রেন।
যদিও ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভ বলেছেন, এ বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ আগ্রাসন শুরুর পর তুরস্কের কাছ থেকে অন্তত ৫০টি ড্রোন সংগ্রহ করেছে ইউক্রেন। রুশ আগ্রাসন না হলে ইউক্রেনে যৌথভাবে ওই ড্রোন উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরুর কথা ছিল তুরস্কের প্রতিষ্ঠান বাইকার টেকনোলজির।
মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতির ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকে এমন একটি ওয়েবসাইট আল মনিটরের জুন মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুরস্কের প্রতিষ্ঠান বাইকার টেকনোলজি সাধারণত ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে (প্রায় ৯৫ কোটি টাকা) প্রতিটি বাইরাকটার টিবি২ বিক্রি করে থাকে। তবে ইউক্রেনের কাছে প্রতিটি ড্রোনের জন্য প্রতিষ্ঠানটি ৭ মিলিয়ন ডলার করে নিয়েছে।
১৯৮৬ সালে গাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতি সরবরাহের উদ্দেশ্যে তুরস্কের বাইকার টেকনোলজির যাত্রা শুরু হয়েছিল। তবে নানা স্তর পার হয়ে ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে বাইরাকটার টিবি২ ড্রোন সরবরাহ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক বাইরাকটার টিবি২ ড্রোন সরবরাহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
ওই ড্রোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাইকার টেকনোলজির প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা হলেন সেলুক বাইরাকটার। তিনি ও তাঁর ভাই হালুক বাইরাকটার এ প্রতিষ্ঠানের মূল নিয়ন্ত্রক। এর মধ্যে সেলুক বাইরাকটার হচ্ছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের জামাতা।
সেলুক বাইরাকটার সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, বিমানবিধ্বংসী ব্যবস্থা ও উন্নত প্রযুক্তির গোলা ছোড়ার পাশাপাশি আকাশে সাঁজোয়া যান হিসেবে ঘুরে বেড়ানোর সক্ষমতা আছে বাইরাকটার টিবি২–এর। প্রতিবছর অন্তত ২০০ ড্রোন উৎপাদনের সামর্থ্য আছে বাইকার টেকনোলজির।
বাইকার টেকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ১৪টি দেশ বাইরাকটার টিবি২ কিনেছে। আরও ১৬টি দেশ ড্রোনটি কিনছে।
নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, চিরাচরিত যুদ্ধে ড্রোন কীভাবে নিয়ামক ভূমিকা রাখে, নাগোরনো–কারাবাখ যুদ্ধে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার লড়াইয়ে সেটা প্রমাণিত হয়েছে।
এবার রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে তুরস্কের ড্রোনের ভূমিকা আরেকবার জোরালোভাবে প্রমাণিত হলো। যুদ্ধের গতিপথ পাল্টে দেওয়ার ক্ষেত্রে ড্রোনের এ ভূমিকার কারণে বিশ্বের সব দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে এ নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের পাশাপাশি সামর্থ্য বাড়ানোর পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ড্রোনের প্রয়োজন আছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য ভালো উৎস হতে পারে তুরস্ক।