নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) দরজার সামনে রোগীর স্বজনেরা ভিড় করেছিলেন। চিকিৎসক শয্যা নম্বর ডেকে ডেকে স্বজনদের জানাচ্ছিলেন তাঁদের রোগীর অবস্থা কেমন। একপর্যায়ে ডাক পড়ল শয্যা নম্বর ৮-এর রোগীর স্বজনদের। এ শয্যার রোগী সুমাইয়া আক্তার ওরফে মৌ। তাঁর বড় বোনকে চিকিৎসক বলেন, ‘কত দিন এমন অবস্থা থাকবে, তা আল্লাহ জানেন!’
গত ২৫ ডিসেম্বর সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সি ব্লকের ৯ তলায় আইসিইউর সামনে এ দৃশ্য দেখা গেল।
রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশনের (নিটোর) বিএসসি ইন ফিজিওথেরাপির চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী ছিলেন সুমাইয়া (২৫)। পরিবার-স্বজনের আর বেশি দিন তাঁর জীবন-মৃত্যু নিয়ে অনিশ্চয়তায় রাখেননি তিনি! গত বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) ভোরে সুমাইয়া মারা যান।
সুমাইয়া ডেঙ্গু-পরবর্তী ভয়াবহ জটিলতায় ভুগছিলেন। চিকিৎসার ভাষায় একে বলা হয় ‘ক্রনিক প্যানক্রিয়েটাইটিস উইথ মেনিনগোএনসেফালাইটিস উইথ সেপটিসিমিয়া’। চার মাস ধরে সুমাইয়াকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটেছেন পরিবারের সদস্যরা। সবশেষ ২ ডিসেম্বর তাঁকে বিএসএমএমইউর আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, এক্সপ্যান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমে সংক্রমণ সুমাইয়ার মস্তিষ্কসহ বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গুর পর অনেকের নানা জটিলতায় ভোগার ঘটনা ঘটছে। তবে এত দীর্ঘ সময় ধরে জটিলতা থাকার ঘটনা খুব কমই পাওয়া যায়।
সুমাইয়ার অবস্থাকে ‘খুব জটিল’ বলে মন্তব্য করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ।
সুমাইয়া ডেঙ্গু-পরবর্তী ভয়াবহ জটিলতায় ভুগছিলেন। চিকিৎসার ভাষায় একে বলা হয় ‘ক্রনিক প্যানক্রিয়েটাইটিস উইথ মেনিনগোএনসেফালাইটিস উইথ সেপটিসিমিয়া’। চার মাস ধরে সুমাইয়াকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটেছেন পরিবারের সদস্যরা।
২৫ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় বিএসএমএমইউয়ে গিয়ে দেখা যায়, আইসিইউর সামনে মাদুর পেতে অপেক্ষায় আছেন বিভিন্ন রোগীর স্বজনেরা। সেখানেই বসে দোয়াদরুদ পড়ছিলেন সুমাইয়ার মা মোসাম্মৎ হোসনে আরা। ২২ দিন ধরে সেখানেই রাত-দিন পার করছিলেন তিনি। মাদুরে বালিশ পেতে গায়ে কম্বল জড়িয়ে ঘুমাতেন। সঙ্গে থাকতেন সুমাইয়ার বড় ও ছোট বোন। সুমাইয়ার কথা বলতে গিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন মা হোসনে আরা। বললেন, ‘আমার এই কষ্ট কোনো কষ্টই না! আমার মেয়েটা ফিরে আসুক। মেয়েটা অনেক কষ্ট করছে। আল্লাহর কাছে মেয়ের প্রাণ ভিক্ষা চাই!’
এফ এম ইকবাল ও হোসনে আরা দম্পতির তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন সুমাইয়া। মা-বাবা খুলনায় শিপইয়ার্ড এলাকায় বাস করেন। লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় বাসা ভাড়া করে থাকতেন সুমাইয়া।
সুমাইয়ার বড় বোন সাদিয়া আফরিনও নিটোরে ফিজিওথেরাপির ছাত্রী। তিনি বিবাহিত। ২৫ ডিসেম্বর হাসপাতালে এ প্রতিবেদককে তিনি জানান, গত ৩০ আগস্ট ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন সুমাইয়া। তাঁর অগ্ন্যাশয়ে (প্যানক্রিয়াস) সমস্যা দেখা দেওয়ার পর একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়। সেখানে সুস্থ হওয়ার পর সুমাইয়াকে শ্যামলীর বাসায় নিয়ে আসা হয়। এর ১৮ দিন পর পেটে ব্যথা নিয়ে শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয় সুমাইয়াকে। সেখানে কয়েক দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর শরীর খারাপ হলে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। ২০ দিন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে থাকার পর একটি বেসরকারী হাসপাতালে তাঁকে দেখানো হয়। এরপর তাঁকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ও পরে গত ৬ নভেম্বর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে সুমাইয়াকে ভর্তি করা হয় উল্লেখ করে সাদিয়া বলেন, ২০ দিন থাকার পর হাসপাতাল ছাড়ার দিনে সুমাইয়ার ডাবল ভিশন (প্রতিটি জিনিস দুটি করে দেখা) ও মাথা ঘুরানোর সমস্যা দেখা দেয়। তিনি ঘাড় সোজা করতে পারতেন না। একপর্যায়ে খিঁচুনি শুরু হলে সুমাইয়াকে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ডিএমসিএইচ) নেওয়ার পরামর্শ দেন।
সাদিয়া জানান, ডিএমসিএইচে এক দিন থাকার পর চিকিৎসকেরা জানান, সুমাইয়ার আইসিইউ লাগবে। হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি নেই। পরে তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে তিন দিন রাখা হয় এবং পরে ২ ডিসেম্বর বিএসএমএমইউর আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়।
ডেঙ্গু-পরবর্তী এ ধরনের জটিলতার কিছু ঘটনা ঘটছে। জটিলতাগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায়, কেউ কেউ একাধিকবার হয়তো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। একবার আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি রোগী হয়তো বুঝতেও পারেননি। ফলে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার পর অবস্থা জটিল হতে পারে।এ বি এম আবদুল্লাহ, ইমেরিটাস অধ্যাপক
বিএসএমএমইউর সি ব্লকের আইসিইউর চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলছিলেন, ডেঙ্গু-পরবর্তী জটিলতা নিয়ে এই আইসিইউতে অনেক রোগী ভর্তি হয়েছিলেন। কেউ সুস্থ হয়েছেন, কেউবা মারা গেছেন। তবে এত দীর্ঘ সময় ধরে জটিলতায় ভুগছেন, সুমাইয়ার মতো এমন রোগী এখানে পাওয়া যায়নি।
হারুন অর রশিদ বলেন, আগের চিকিৎসাসংক্রান্ত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, তিনি (সুমাইয়া) এক্সপ্যান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমে ভুগেছেন। তাঁর মস্তিষ্ক, যকৃৎ, ফুসফুস, অগ্ন্যাশয় ও রক্তে সংক্রমণ হয়েছে। তাঁর গ্লাসগো কোমা স্কেল বা জিসিএস (মস্তিষ্কের আঘাতের কারণে কোনো ব্যক্তির চেতনার মাত্রা পরিমাপ) স্বাভাবিক মাত্রা থেকে অর্ধেকে নেমে আসে। রক্তে শ্বেতকণিকা স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি হয়। ফলে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।
ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ ২৫ ডিসেম্বর মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গু-পরবর্তী এ ধরনের জটিলতার কিছু ঘটনা ঘটছে। জটিলতাগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায়, কেউ কেউ একাধিকবার হয়তো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। একবার আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি রোগী হয়তো বুঝতেও পারেননি। ফলে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার পর অবস্থা জটিল হতে পারে।
এ বি এম আবদুল্লাহ আরও বলেন, অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন কি না, বুঝতে না পেরে চিকিৎসা নিতে দেরি করে ফেলেন। এতে বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটে, রোগীর অবস্থা জটিল হয়ে যায়। আবার ফ্লুইড ব্যবস্থাপনাসহ (শিরায় স্যালাইন দেওয়া) যে ধরনের চিকিৎসা প্রয়োজন, সে ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে কি না, সেটার ওপরও রোগীর সুস্থতা নির্ভর করে।
হাসপাতালে ভর্তি থাকার কারণে চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা দিতে পারেননি সুমাইয়া। হাসপাতালে পড়ার চেষ্টা করতেন। পরিবার-অন্তঃপ্রাণ সুমাইয়ার সব কিছুই ছিল পরিবারকে ঘিরে। বাবা কিছু করার আগে সুমাইয়ার সঙ্গে পরামর্শ করতেন। শুরুতে আইসিইউতে থাকার সময় মা-বাবা, ভাই-বোনদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতেন; ‘কলিজা, কলিজা’ বলে ডাকতেন।
সুমাইয়াইকে নিয়ে চার মাস ধরে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরেছেন স্বজনেরা। এর মধ্যে একটা বড় সময় তাঁকে থাকতে হয় আইসিইউতে।
চিকিৎসার ব্যয় সম্পর্কে জানতে চাইলে ২৫ ডিসেম্বর মা হোসনে আরা প্রথম আলোকে বলেন, ৪ মাসে ১০ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। একটি জমি বিক্রি করা হয়েছে। জমানো টাকা খরচ করা হয়েছে। তবে মেয়ের জীবনের জন্য সম্পদ তাঁদের কাছে তুচ্ছ। তাই আরেকটি জমি বিক্রির চেষ্টা চলছে।
মায়ের বিশ্বাস ছিল, সুমাইয়া সুস্থ হয়ে উঠবেন। হোসনে আরা বলেছিলেন, সুমাইয়া অনেক মেধাবী।
হাসপাতালে ভর্তি থাকার কারণে চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা দিতে পারেননি। হাসপাতালে পড়ার চেষ্টা করতেন।
পরিবার-অন্তঃপ্রাণ সুমাইয়ার সবকিছুই ছিল পরিবার ঘিরে। বাবা কিছু করার আগে সুমাইয়ার সঙ্গে পরামর্শ করতেন। শুরুতে আইসিইউতে থাকার সময় মা-বাবা, ভাই-বোনদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতেন; ‘কলিজা, কলিজা’ বলে ডাকতেন।
সুমাইয়ার মৃত্যুর পর মা হোসনে আরা পুরো ভেঙে পড়েছেন। সুমাইয়ার বড় বোন সাদিয়া গত রোববার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সুমাইয়া পুরো পরিবারকে আগলে রাখতেন। এখন সুমাইয়ার শূন্যতায় মাকে কীভাবে সামলাবেন, আর নিজেরাই কিসে সান্ত্বনা খুঁজে পাবেন, সেই অসহায়ত্ব ছিল সাদিয়ার কণ্ঠে।