মন্ত্রী হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের মেয়াদ ১১ বছর পার হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, সড়কে শৃঙ্খলা আসেনি, বরং মৃত্যু বেড়েছে।
দেশে আরেকটি বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটল। মৃত্যু হলো ১৯ জনের। এরপর জানা গেল, দুর্ঘটনায় পড়া বাসটির চালক সর্বশেষ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ ঘণ্টার বেশি বাস চালিয়ে ক্লান্ত ছিলেন। বাসটি চালানোর অনুমোদন ছিল না, ফিটনেস সনদের মেয়াদও পেরিয়ে গেছে।
দুর্ঘটনাটি ঘটে গত রোববার মাদারীপুরের শিবচরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক্সপ্রেসওয়েতে। এর আগে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজারের চকরিয়ায় পিকআপচাপায় একসঙ্গে ছয় ভাই নিহত হওয়ার পর বেরিয়ে আসে যে পিকআপটির অনুমোদনসংক্রান্ত হালনাগাদ কোনো কাগজপত্র ছিল না। চালকেরও লাইসেন্স ছিল না।
এভাবে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, হয় সংশ্লিষ্ট বাহনের চলাচলের অনুমোদন বা রুট পারমিট নেই, নয়তো ফিটনেস সনদ নেই। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সড়কে এই নৈরাজ্য চলছে বহু বছর ধরে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় নৈরাজ্য দূর করার ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। মন্ত্রণালয়টি শুধু এ ক্ষেত্রেই নয়, বাস ও অটোরিকশায় নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করা, অধীন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সেবা সহজ করা ও দুর্নীতি কমানো, সড়কের মান উন্নত করা এবং সময়মতো ও নির্ধারিত ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা—এসব ক্ষেত্রেও কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে দেশে ভাড়া নিয়ে বচসার কারণে যাত্রীকে মার খেতে হচ্ছে, বাসচাপায় মরতে হচ্ছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে মন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন ওবায়দুল কাদের। দায়িত্ব নিয়ে শুরুর দিকে তিনি মাঠেঘাটে, সড়কে দৌড়াতেন। অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। প্রকাশ্যে কর্মকর্তাদের ধমকও দিতেন। ‘মাসুদ ভালো হয়ে যাও’—তাঁর এই বক্তব্য তো সবার মুখে মুখে।
মন্ত্রীর এই তৎপরতা মানুষের মনে আশা জাগিয়েছিল। যাত্রীরা ভেবেছিলেন, এবার বুঝি পরিবর্তন আসবে। অবশ্য মন্ত্রী হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের মেয়াদ ১১ বছর পার হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, সড়কে শৃঙ্খলা আসেনি, বরং মৃত্যু বেড়েছে।
ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী থাকা অবস্থায়ই পদ্মা সেতু হয়েছে এবং মেট্রোরেলের মতো কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে। তবে এসব কাজ সরকারের অগ্রাধিকার বা ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের আওতাধীন। বাস্তবায়নে তদারকি করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও। শুধু সড়ক মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা যেসব প্রকল্পে, সেগুলোর মেয়াদ ও ব্যয় বারবার বাড়ানো হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে উদাহরণ বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পটি (বিআরটি)। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার পথে বিশেষ বাস চালুর লক্ষ্যে এই প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১২ সালে। ২০১৬ সালে বিআরটি চালুর কথা ছিল। এখনো শেষ হয়নি। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা। তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। অব্যবস্থাপনার কারণে বিআরটি প্রকল্প এক দশকের বেশি সময় ধরে মানুষকে ভোগাচ্ছে। সঙ্গে দুই দফা গার্ডার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন সাতজন।
চাঁদেরও কলঙ্ক আছে, এর জন্য কি চাঁদের উজ্জ্বলতা হারিয়ে গেছে? কাজ করতে গেলে কিছু ব্যর্থতা তো থাকবেই।ওবায়দুল কাদের, মন্ত্রী, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়
স্বাধীনতার পর থেকে দেশে যোগাযোগ বা পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ২৫ জন। এঁদের কেউ সাত বছরের বেশি দায়িত্বে ছিলেন না। একমাত্র বর্তমান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দায়িত্ব পালন করেছেন টানা এক দশকের বেশি সময় ধরে। তিনি তিন মেয়াদ ধরে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মন্ত্রী হিসেবে নিজের কাজ করতে যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দরকার, সেটা ওবায়দুল কাদেরের রয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি।
যেকোনো মন্ত্রণালয়ের প্রধান ব্যক্তি মন্ত্রী। সচিব প্রশাসনিক প্রধান। মন্ত্রণালয় কোনো কাজে সফল না হলে দায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপরই বর্তায় বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ৮ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে সড়কমন্ত্রীর কাছে এই প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, তিনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা আনা, দুর্ঘটনা কমানো ও যানজট নিরসনকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। সে অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ার বিষয়টিকে তিনি কীভাবে দেখেন। জবাবে তিনি বলেন, ‘কর্মে, কর্তব্য পালনে একজন মানুষ কখনোই পারফেক্ট (পরিপূর্ণ) নয়। চাঁদেরও কলঙ্ক আছে, এর জন্য কি চাঁদের উজ্জ্বলতা হারিয়ে গেছে? কাজ করতে গেলে কিছু ব্যর্থতা তো থাকবেই। সফলতার মধ্যে ব্যর্থতা আছে, শতভাগ সফলতা সম্ভব না।’
২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকেই তিনি নিজের দপ্তরে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। এখন তিনি সপ্তাহে এক দিন, কখনো কখনো মাসে দু-চারবার নিজ দপ্তরে যান। তা–ও সংবাদ সম্মেলন, বড় কোনো সভা কিংবা বিদেশি কূটনীতিকদের সাক্ষাতের অনুষ্ঠান থাকলে।
অবশ্য অনেকে মনে করেন, সড়কে শৃঙ্খলা মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন। এখানে ঘাটতি গ্রহণযোগ্য নয়। আর নিরাপদ সড়ক আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও ছিল। ২০১৮ সালে দলের ইশতেহারে বলা হয়, নিরাপদ সড়কের জন্য লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, ট্রাফিক–ব্যবস্থাকে আধুনিক করা, ফিটনেসবিহীন গাড়িকে পারমিট (অনুমোদন) না দেওয়া, চালকদের লাইসেন্স দিতে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ এবং সড়ক আইন, ২০১৮ প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্ঘটনা ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ইশতেহারের এই অঙ্গীকার পূরণ করতে পারছেন না দলের সাধারণ সম্পাদকই।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ওয়েবসাইটে কৌশলগত উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, মহাসড়ক নেটওয়ার্কের উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা, দ্রুতগতিসম্পন্ন গণপরিবহনব্যবস্থা প্রবর্তন ও সম্প্রসারণ, সড়ক নিরাপত্তা জোরদার করা, সরকারি পরিবহনসেবা সম্প্রসারণ, সড়ক বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো, মোটরযান–ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন এবং সংস্কার ও সুশাসনমূলক কার্যক্রমের বাস্তবায়ন জোরদার করা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের যেসব কাজ উন্নয়নের, অর্থাৎ কেনাকাটা, দরপত্র ও ঠিকাদারকে কাজ দেওয়ার বিষয় আছে, সেখানে নজর বেশি। যেসব কাজ ব্যবস্থাপনা উন্নত করা, দুর্নীতি দূর করা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেখানে ব্যাপক ঘাটতি।
মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ওবায়দুল কাদের মাঝেমধ্যেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিদর্শনে যেতেন। ২০১২ সালে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ওই বছর মন্ত্রী দেশের ৫৯টি জেলা ও ২১০ উপজেলার সড়ক একাধিকবার পরিদর্শন করেছেন। তিনি সে সময় কখনো কখনো নিজেই যাত্রী সেজে বাসে উঠে বাড়তি ভাড়া আদায় হচ্ছে কি না, তা যাচাই করতেন। বাসের ফিটনেস সনদ আছে কি না তা যাচাই করতেও দেখা গেছে তাঁকে। এখন আর তার সেই দৌড়ঝাঁপ দেখা যায় না।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ওবায়দুল কাদের মন্ত্রণালয়েই কম যাচ্ছেন। সেটা শুধু সাম্প্রতিক প্রবণতা নয়, ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকেই তিনি নিজের দপ্তরে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। এখন তিনি সপ্তাহে এক দিন, কখনো কখনো মাসে দু-চারবার নিজ দপ্তরে যান। তা–ও সংবাদ সম্মেলন, বড় কোনো সভা কিংবা বিদেশি কূটনীতিকদের সাক্ষাতের অনুষ্ঠান থাকলে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, মন্ত্রী এলেও এখন খুব কম সময় থাকেন। মন্ত্রণালয়ের বা বিভাগের নথি সই করাতে অনেক সময় ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা তাঁর বাসায় যান। অথবা সুবিধামতো জায়গায় নিয়ে গিয়ে সই করান।
সম্প্রতি মেট্রোরেল চালু হলেও রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের গণপরিবহন বলতে বোঝায় বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ট্যাক্সিক্যাবকে। এই দুই নগরের বেশির ভাগ বাস-মিনিবাস জীর্ণ ও লক্কড়ঝক্কড়। বাসের চিটচিটে ও নোংরা আসনে বসে হেলান দিলে যাত্রীর পোশাক নোংরা হয়ে যায়। বাসে পরিবহনমালিকেরা ইচ্ছেমতো আসন বসিয়েছেন, গাদাগাদি করে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে, ‘সিটিং’ সার্ভিসের নামে বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে—মন্ত্রণালয় এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
২০০৩ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালু হয়, যা কোনো দিনই নির্ধারিত ভাড়া মানেনি। নগরে ট্যাক্সিক্যাব সেবা এখন নেই বললেই চলে। রয়েছে শরিকি যাত্রা বা রাইড শেয়ারিং। সেখানে ভাড়ার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই।
গণপরিবহনের এই দশার কারণে নগরের মানুষের বিকল্প বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে রিকশা, হিউম্যান হলার ও টেম্পো। আর এই বাহনগুলোর ভাড়ার কোনো নীতিমালা বা কর্তৃপক্ষই নেই। ফলে তারাও সংকটের ইচ্ছেমতো সুযোগ নিচ্ছে।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ফারিহা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকালবেলা ঢাকায় নারীদের পক্ষে কোনো বাসে ওঠার উপায় থাকে না। অটোরিকশা ভাড়া চায় দ্বিগুণ। শুধু অফিসে যাতায়াতে আমার মাসে ১৫ হাজার টাকার বেশি ব্যয় হয়।’ তিনি বলেন, সুশৃঙ্খল একটি বাসসেবা চালু বা অটোরিকশায় ভাড়ার নৈরাজ্য দূর করার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা তো সরকারি গাড়িতে চড়েন। নৈরাজ্য দূর করার ঠেকা তো তাঁদের নেই।
সড়কে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা এবং সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সরকারের দুটি সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম হলো জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল ও জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদ। এই দুটিরই প্রধান পদাধিকার বলে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কমিটি সময়-সময় বৈঠক করে, সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু নগরে যানজট, সড়ক-মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা কিংবা দুর্ঘটনায় প্রাণহানি—কোনোটাই কমে না।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে মাঠে নামলে সরকার তৎপর হয়ে ওঠে। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী শৃঙ্খলা ফেরাতে সুপারিশ তৈরির দায়িত্ব দেন পরিবহন খাতের শ্রমিকদের শীর্ষনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানকে। তাঁর নেতৃত্বে ২২ সদস্যের একটি কমিটি ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ১১১ দফা সুপারিশ জমা দেয়। সড়কমন্ত্রী এই ১১১ দফা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্সকে।
সড়কমন্ত্রী নিজে না নিয়ে দায়িত্ব অন্যদের ওপর দেওয়ার পর সুফল তেমন একটা পাওয়া যায়নি। সড়ক আইন এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। ২০১৮ সালে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের ধর্মঘট ও চাপের মুখে সড়ক আইন পর্যালোচনার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও রেলমন্ত্রীকে দায়িত্ব দেন ওবায়দুল কাদের। পরে তাঁরা আইনের সংশোধনী প্রস্তাব তৈরি করেন। গত বছর সংশোধনী জমা হলেও এখনো এর সুরাহা হয়নি।
ঢাকার গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা দূর করতে ২০০৫ সালে করা ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনায় ‘বাস রুট র্যাশনালাইজেশন’ বা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ চালু করার পরামর্শ আসে। বিশেষ এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল লক্কড়ঝক্কড় বাস উঠিয়ে দেওয়া, নতুন বাস নামানো এবং পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনা। এক দশক এই চিন্তা হিমাগারে ছিল। ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়ে আনিসুল হক কাজটি এগিয়ে নেন। এখন বাস্তবায়ন করছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি এ পর্যন্ত ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে তিনটি রুটে বাস নামাতে পেরেছেন। তবে এই সেবা নিয়ে নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ রয়েছে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামলে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলেছিলেন, ‘শিশুরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে, বিবেককে জাগ্রত করেছে।’ কিন্তু পরিবর্তন আসেনি। সড়কে মৃত্যু বাড়ছেই। সরকারি হিসাবে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয় ২ হাজার ৪৬০ জনের। এরপর প্রতিবছরই প্রাণহানি বেড়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে সড়কে প্রাণ গেছে ৭ হাজার ৭১৩ জনের।
নিরাপদ সড়কের মূল অনুষঙ্গ বিবেচনা করা হয় নিরাপদ যান, দক্ষ চালক ও ভালো সড়ককে। ঘাটতি তিনটি ক্ষেত্রেই। অভিযোগ রয়েছে, দেশে লক্কড়ঝক্কড় যান অনায়াসে ফিটনেস সনদ পাচ্ছে বিআরটিএতে। চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা হয় নামমাত্র। তা–ও সময়মতো লাইসেন্স দিতে পারে না নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। সর্বশেষ হিসাবে, আবেদন করে লাইসেন্সের অপেক্ষায় রয়েছেন ৪ লাখ ৮১ হাজার মানুষ।
মাদারীপুরের শিবচরে গত রোববার যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেটা ‘ঠেকানো যেত’ ২০১৮ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া অনুশাসন বাস্তবায়িত হলে। মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী একজন চালককে আট ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে না দেওয়া, দূরপাল্লার চালকদের জন্য মহাসড়কের পাশে বিশ্রামাগার নির্মাণ, দূরের পথে বিকল্প চালক রাখাসহ পাঁচটি অনুশাসন দেন, যা বাস্তবায়িত হয়নি। উল্লেখ্য, শিবচর হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু নাঈম মো. মোফাজ্জেল হক প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি প্রাথমিকভাবে জেনেছেন যে দীর্ঘ সময় বাস চালানোর কারণে চালক ক্লান্ত ছিলেন। ঘুম ঘুম চোখে বাস চালানোয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন তিনি।
ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় যোগাযোগ ও পরিবহন খাতের সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনার অধীনে। আর এটি সমন্বয়ের দায়িত্বে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। এর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ঢাকার দুই মেয়র ভাইস চেয়ারম্যান। সরকারের ২৬টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ও দপ্তরের প্রধানেরা সদস্য। অথচ একেক সংস্থা একেক রকম প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
যেমন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড ঢাকায় ছয়টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ করছে। এর জন্য কয়েক লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে। অথচ একই মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা সেতু বিভাগ একই ধরনের গণপরিবহনব্যবস্থা সাবওয়ে বা পাতালরেল নির্মাণে ৩২১ কোটি টাকা খরচ করে সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। অন্যদিকে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের কারণে উদ্বোধনের পরই ভাঙতে হবে ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৩০০ ফুট সড়কের কিছু অংশ।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের হিসাবে, ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে পরবর্তী ১০ অর্থবছরে সড়ক, সেতু, মেট্রোরেল, উড়ালসড়কসহ নানা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অন্যদিকে সেতু বিভাগের অধীনে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল, ঢাকা উড়ালসড়ক নির্মাণসহ নানা প্রকল্পে আরও ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। রাজস্ব খাতের রক্ষণাবেক্ষণ ও বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় তো রয়েছেই।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) অধীনে এখন ১৪৪টি প্রকল্প চলমান। এক যুগ ধরে প্রতিবছরই দেড় শর কাছাকাছি প্রকল্প চলমান ছিল। তবে নিরাপদ সড়কসংক্রান্ত প্রকল্প গুটিকয়। এর মধ্যে ১৬৫ কোটি টাকায় ১৪৮টি আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কের বাঁক সোজা করা হয়েছে। এদিকে সরকারের পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) ৩ লাখ দক্ষ চালক তৈরির জন্য ৯৭৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করেছিল বছর চারেক আগে। সেটি এখনো অনুমোদন হয়নি।
২০১৯ সালের নভেম্বরে ২২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি বিশ্রামাগার নির্মাণে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। সওজের তথ্য, সাড়ে তিন বছরে প্রকল্পটির কাজ এগিয়েছে ৫০ শতাংশের মতো।
সড়কে নিরাপত্তা নিয়ে আন্দোলনকারী সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাইয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, আন্তরিকতা ও তীব্র ইচ্ছার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু করে ফেলেছেন। সড়ক নিরাপদ করতে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় তীব্র ইচ্ছা ও আন্তরিকতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার প্রস্তাব হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ কোনো সচিবকে দিয়ে আলাদা একটা বিভাগ করা যেতে পারে, যারা অন্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে সড়ক নিরাপদ করবে।’
সড়কে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে না পারার দায় কার, জানতে চাইলে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক পরিবহনমন্ত্রী নিজেই তো পাঁচ–সাতবার সাংবাদিকদের বলেছেন সড়কে শৃঙ্খলা আনতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এখন কেন ব্যর্থ হয়েছেন, সেটা তিনিই বলতে পারেন।
বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সড়ক মন্ত্রণালয় কতটা সফল, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, মন্ত্রণালয়টির প্রকল্পগুলো দীর্ঘসূত্রতা ও ব্যয় বৃদ্ধির চক্রে রয়েছে। যেমন ঢাকা উড়ালসড়ক (ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) প্রকল্পের নির্মাণকাজ ২০১১ সালে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৩৫ শতাংশ। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। পরে ১ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা বাড়ানো হয়।
গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে প্রকল্প অনুমোদন হয় ২০১৩ সালে। শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা। শেষ পর্যন্ত ব্যয় দাঁড়ায় ৬ হাজার ২১৪ কোটি টাকা। সড়কটি গত ডিসেম্বরে চালু হয়েছে। এখনো কিছু কাজ চলছে।
এলেঙ্গা থেকে রংপুর পর্যন্ত ৯০ কিলোমিটার অংশ চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৬ সালে। শেষ হওয়ার কথা ২০২১ সালে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৪১ শতাংশ। ১১ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা।
সড়কগুলোর নির্মাণ ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ২০১৭ সালের জুনে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয় এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে প্রতিবেশী ভারত ও চীনের তুলনায় অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করে বাংলাদেশ। এই বাড়তি খরচের জন্য দায়ী উচ্চমাত্রায় দুর্নীতি, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়া ও দরপত্রে প্রতিযোগিতা না থাকা। বিশ্বব্যাংক তখন জানিয়েছিল, চার লেন সড়কের মধ্যে রংপুর-হাটিকুমরুল মহাসড়কে কিলোমিটারপ্রতি ৬৬ লাখ ডলার, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ৭০ লাখ ডলার, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে ১ কোটি ১৯ লাখ ডলার, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ২৫ লাখ ডলার এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ২৫ লাখ ডলার ব্যয় ধরা হয়। ভারতে চার লেন সড়কে ব্যয় ১১ থেকে ১৩ লাখ ডলার এবং চীনে ১৩ লাখ থেকে ১৬ লাখ ডলার।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ অবকাঠামো গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন দেশে এই খাতে বিনিয়োগ কম ছিল। সরকার এই খাতে বিনিয়োগে জোর দিয়েছে। এটা ভালো কথা। কিন্তু এটি সড়ক নিরাপদ বা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে একটি উপাদানমাত্র। এর সঙ্গে চালক ও যানবাহন ঠিক আছে কি না, তা গুরুত্বপূর্ণ। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে সফলতা দেখাতে পারেনি।