শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বপ্নের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করার প্রত্যয় জানানো হয়।
আজ শনিবার সকাল থেকে রাজধানীর রায়েরবাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে সমবেত হয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ। শ্রদ্ধার ফুলে ভরে ওঠে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের বেদি।
পাশাপাশি মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধেও রাজনৈতিক দল ও সংগঠন ছাড়াও সাধারণ মানুষের ঢল নামে।
রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসা রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের মধ্যে ছিল বিএনপি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় নাগরিক কমিটি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ, গণফোরাম, জাতীয় পার্টি (জাপা), সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণ অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী সংগঠন ও সংস্থা।
রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে আসা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জানিয়েছেন, একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য শহীদ বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এখন সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে বৈষম্যহীন, মানবিক এবং গণতান্ত্রিক দেশ গড়ে তুলতে হবে।
মোহাম্মদপুরের শের শাহ সূরি রোড থেকে পাঁচ বছরের সন্তান শফিউল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে এসেছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী আনোয়ারুল ইসলাম। ছেলেকে একটি ছোট্ট পতাকা কিনে দিয়েছেন তিনি। নিজের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন উল্লেখ করে আনোয়ারুল প্রথম আলোকে বলেন, ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দিতেই বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে নিয়ে এসেছেন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ছেলেকে নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধেও যাওয়ার পরিকল্পনা আছে তাঁর।
আনোয়ারুল বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছরে যারাই ক্ষমতায় এসেছে, তারাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছে। তাঁর প্রত্যাশা, নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জেনে দেশ গঠনে একসঙ্গে কাজ করবে।
শ্রদ্ধা নিবেদনের পর কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের প্রেসিডিয়াম সদস্য শ্যামল বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও মানবিক, গণতান্ত্রিক ও সমতার বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা যায়নি। এ কারণেই গত ৫ আগস্ট একটি গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। এখন স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হলেই কেবল অসম্পূর্ণ স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। পাশাপাশি মানবিক ও বিজ্ঞানমনস্ক দেশপ্রেমিক প্রজন্ম গড়ে উঠবে।’
রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলো এ দেশের মানুষের মূল পরিচয়ের স্মারক। আজকের এই দিনে জাতির সূর্যসন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে একটি জাতি গঠিত হয়েছে। তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের পর এ বছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আলাদা তাৎপর্য বহন করছে। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্ররা দেখিয়েছে, এ দেশের মানুষ অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না। তাঁরা দেখিয়েছেন, কীভাবে রুখে দাঁড়াতে হয়।’
সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সদস্য আরিফ সোহেল বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে একটি মহল জল ঘোলা করার চেষ্টা করছে। একটি মহল বলার চেষ্টা করছে, তরুণ প্রজন্মের রক্তের বিনিময়ে যে নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে, সেই বাংলাদেশ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কিন্তু চব্বিশের অভ্যুত্থান হলো একাত্তরের ধারাবাহিকতা।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সকাল ৭টায় মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন সেখানে আসা আহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অন্য আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ৭টা ১৫ মিনিটে। এরপর তিনি সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রীয় সালাম প্রদান করে এবং এ সময় বিউগলে করুণ সুর বাজানো হয়। শ্রদ্ধা জানানোর পর প্রধান উপদেষ্টা উপদেষ্টামণ্ডলী, শীর্ষ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং অন্য আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজমের নেতৃত্বে শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যরা এবং যুদ্ধাহত ও উপস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধারা সকাল ৭টা ২২ মিনিটে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে এবং সকাল সাড়ে ৮টায় রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এ ছাড়া সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সর্বস্তরের মানুষ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য চক্রান্ত করেছিল। তারা তাদের এদেশীয় দোসরদের নিয়ে শিক্ষক, বিজ্ঞানী, চিন্তক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, ক্রীড়াবিদ, সরকারি কর্মকর্তাসহ দেশের বহু কৃতী সন্তানকে হত্যা করে। বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পর রাজধানীর রায়েরবাজার ইটখোলা, মিরপুরের বধ্যভূমিসহ ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের চোখ-হাত বাঁধা ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায়। স্বাধীনতার পর থেকে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।