তীব্র রোদ ও গরমের মধ্যে কাজ করছেন দুই শ্রমিক। লঞ্চঘাট, বাংলাবাজার, পাবনা
তীব্র রোদ ও গরমের মধ্যে কাজ করছেন দুই শ্রমিক। লঞ্চঘাট, বাংলাবাজার, পাবনা

বৈরী প্রকৃতি

শ্রমিক যে একটু জিরাবেন, সেই ছায়াও নেই

রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের পাশে গালিব সরণির মুখে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলেন রিকশাচালক কাওসার মিস্ত্রী। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তাঁর সঙ্গে দেখা। ঘণ্টা দেড়েক আগে রিকশা চালানো শুরু করেছিলেন। এর মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার ষাট ছুঁই ছুঁই মানুষটি। তিনি বলেন, ‘এই সকালেও গরমে চলতি পারছিনে। কিন্ত কী করব, কাজ তো করতি হবে। একটু রিকশা চালাই, আবার জিরোই। জিরোব যে, ছায়াও তো নেই।’

কাওসার মিস্ত্রীর মতো শ্রমজীবী মানুষদের জন্য দেশজুড়ে বয়ে চলা টানা তাপপ্রবাহ কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাপপ্রবাহের কারণে দেশজুড়ে দেওয়া হয়েছে তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা। এ সময় বাইরে রোদের সময় চলাফেরা যতদূর সম্ভব কমানোর পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু শ্রমিকদের কি আর তা মানলে চলে? এসব নির্দেশ আর পাঁচ-দশটা মানুষের পক্ষে মেনে চলা সম্ভব হলেও শ্রমিকদের জন্য তা মানার উপায় নেই। আর এ কারণে অনেকেই স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। এমন অবস্থায় শ্রমিকের সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে শ্রম আইনে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন নেই।

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে অতি তাপ, অতিবৃষ্টি, অধিক শীতের মতো সমস্যা বাংলাদেশেও সৃষ্টি হচ্ছে। শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় ‘জাস্ট ট্রানজিশন’ বা ‘ন্যায্য রূপান্তর’–এর কথা বলা হচ্ছে। এর অর্থ হলো, শ্রমিকদের জন্য পরিবেশবান্ধব কর্মপরিবেশের ব্যবস্থা করা। কিন্তু বাংলাদেশ এ থেকে অনেক পিছিয়ে। এ অবস্থায় আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস।

বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপ–২০২২ অনুযায়ী, দেশের মোট শ্রমশক্তির সংখ্যা সাত কোটির বেশি। এর মধ্যে অনানুষ্ঠানিক খাতেই রয়েছে প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ। এ খাতের মানুষেরা চাকরি ও মজুরি নিয়ে থাকেন ঝুঁকিতে। চলমান তাপপ্রবাহে মাঠে-ঘাটে কাজ করতে বাধ্য হওয়া শ্রমিকেরা রয়েছেন বড় বিপদে। নির্মাণশিল্প, চা–বাগান ও চিংড়ি ঘেরের শ্রমিকদের ওপর করা পৃথক তিন জরিপ ও পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে তাপপ্রবাহের সময় তাঁদের দুর্বিষহ অবস্থার চিত্র। এসব পর্যবেক্ষণ সমন্বয় করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শ্রমবিষয়ক সংগঠন সলিডারিটি সেন্টার।

নির্মাণশ্রমিকদের ওপর সম্প্রতি জরিপ করেছে ইনসাব নামের সংগঠন। সেখানে তাপপ্রবাহের কারণে ৩৪ ধরনের সমস্যার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রচুর ঘাম হওয়া, পানিশূন্য হয়ে যাওয়া, ডায়রিয়ার মতো সমস্যার কথা আছে। প্রচণ্ড তাপের জন্য কাজে মিলছ না শ্রমিকের। কথা শুনতে হচ্ছে মালিকের।

ইনসাবের সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, কোনো দুর্যোগেই শ্রমিকেরা কোনো সুবিধা পান না। তাপপ্রবাহে কষ্ট বেড়েছে, কিন্তু সহায়তা পাচ্ছেন না শ্রমিকেরা।

তাপপ্রবাহে কষ্টে আছেন চা–শ্রমিকেরাও। শ্রীমঙ্গল উপজেলার মাইজদীহি চা–বাগানে গত ২৩ এপ্রিল কাজ করতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যান নারী চা–শ্রমিক পবিত্রি রায় (৫৫)। এমন অবস্থা অনেক বাগানেই হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ চা–শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নৃপেণ পাল।

অনেক চা–বাগানে পানি ও স্যানিটেশন পরিস্থিতি নাজুক। প্রচণ্ড তাপে তৃষ্ণার্ত শ্রমিকেরা ছড়ার গরম পানিই পান করেন। এতে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে বলে জানিয়েছেন নৃপেন পাল।

শ্রীমঙ্গল উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কিছু কিছু বাগানে পানির সমস্যা আছে। হাসপাতালে রোগীও আসছে একটু বেশি। তাঁদের মধ্যে শ্রমিক ও সাধারণ মানুষও আছেন।

গরমে চিংড়িঘেরের শ্রমিকদের অবস্থা তুলে ধরেছে রূপসা নামের খুলনাভিত্তিক একটি উন্নয়ন সংস্থা। এ গবেষণায় ১২টির মতো সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে।

শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন তাপ বা বৈরী পরিবেশে কেবল কারখানার শ্রমিকের জন্য মালিকের করণীয়ের কথা বলা আছে। কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের জন্য মালিক বা ঠিকাদারের করণীয় সম্পর্কে কোনো আইন বা মানদণ্ড করা হয়নি। আবহাওয়ার বৈরী পরিবেশে এসব শ্রমিকের জন্য সামাজিক সহযোগিতা চালু করা যায়। কিন্তু এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ দেখছি না।’

পরিবেশ ও শ্রমবান্ধব কর্মস্থল সৃষ্টিতে ‘ন্যায্য রূপান্তর’–এর কথা এখন চালু আছে। মুজিব জলবায়ু পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১–এর উল্লেখ করা হয়েছে।

বিলস ও ড্যানিশ ট্রেড ইউনিয়ন ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এ–সংক্রান্ত একটি গবেষণা করেছে। সেখানে অন্যান্য দেশের তুলনা করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ‘ন্যায্য স্থানান্তর’–এর ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। এর জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বাধাই প্রধান।

সলিডারিটি সেন্টারের কান্ট্রি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর এ কে এম নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, এক তৈরি পোশাক খাত ছাড়া শ্রমবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে ‘ন্যায্য রূপান্তর’ নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। এ নিয়ে কোনো উদ্যোগও নেই। যদিও জলবায়ু পরিবর্তন খাতে অর্থায়ন অনেক। কিন্তু সেখানে শ্রমিকের হিস্যা নেই।