চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী উপস্থাপনের ব্যর্থতাকে বিচার নিষ্পত্তির বিলম্বের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, বলেছেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২–এর বিচারক। একই সঙ্গে মামলাটির বিচার নিষ্পত্তিতে বিলম্বের জন্য আরও ছয়টি কারণ তুলে ধরেছেন তিনি।
প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগে আজ সোমবার উপস্থাপিত বিচারকের এক প্রতিবেদনে এসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ ছয় মাসের মধ্যে মামলাটির বিচার শেষ করতে বিচারিক আদালতকে নির্দেশ দেন। ওই মামলার আসামি আশীষ রায় চৌধুরীর জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন শুনানিতে এ আদেশ দেওয়া হয়। এরপর গত ২৯ অক্টোবর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগে ওঠে।
সেদিন আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেন, ছয় মাস সময় ১১ অক্টোবর শেষ হয়েছে। আপিল বিভাগের আদেশ বাস্তবায়িত হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে ৬ ফেব্রুয়ারি দেওয়া আদেশ অনুসারে উল্লেখিত (ছয় মাস) সময়ের মধ্যে মামলাটির বিচার কেন শেষ হয়নি, তার কারণ এক সপ্তাহের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিচারককে জানাতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। এরপর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক এম আলী আহমেদ দেরির কারণ উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাইব্যুনাল আপিল বিভাগের নির্দেশনা গত ২৪ এপ্রিল পান। এরপর বিচার নিষ্পত্তিসংক্রান্ত ১২টি তারিখ ধার্য করেন। ১১-৩৮ নম্বর সাক্ষীর প্রতি আটবার সমন, ২৬ বার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও ১৬৬টি অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ সংশ্লিষ্ট থানায় জারির জন্য পাঠানো হয়। যার অধিকাংশই বিনা তামিলে ফেরত আসে বা আদৌ কোনো প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি। কী কারণে প্রসেস জারি করা যায়নি তা–ও ট্রাইব্যুনালকে জানানো হয়নি, যা পুলিশি গাফিলতি বলে বিবেচিত হয় এবং বিচার নিষ্পত্তির অন্যতম বিলম্বের কারণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এ মামলায় মোট সাক্ষীর সংখ্যা ৩৮। তাঁদের মধ্যে ব্যক্তি সাক্ষী ২৯ জন, পুলিশ সাক্ষী ৬, ম্যাজিস্ট্রেট সাক্ষী ২ ও ডাক্তার সাক্ষী একজন। তাঁদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৭ সাক্ষীর ওপর প্রসেস জারিসংক্রান্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়, যা থেকে দেখা যায় তাঁদের কেউ কেউ (পাঁচজন) মারা গেছেন বা কেউ সিএস বর্ণিত ঠিকানায় বসবাস করেন না।
অপর কারণে বলা হয়, সমন, জামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো সত্ত্বেও বাকি দুজন ম্যাজিস্ট্রেট, চারজন পুলিশ, পাঁচজন পাবলিক সাক্ষীসহ মোট ১১ সাক্ষীর ওপর প্রসেস জারিসংক্রান্ত কোনো পুলিশ প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি। যার কারণে বিচার নিষ্পত্তির কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
চতুর্থ কারণ হিসেবে বিচারক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে ১১ জন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর মধ্যে কনফেশন রেকর্ডিং ম্যাজিস্ট্রেট, তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা ও ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ব্যতীত বা অন্ততপক্ষে তাঁদের ওপর প্রসেস জারিসংক্রান্ত রিপোর্ট না পাওয়ার কারণে মামলাটির বিচার কার্যক্রম সমাপ্ত করা হয়নি, যা ট্রাইব্যুনালে অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কনফেশন রেকর্ডিং ম্যাজিস্ট্রেটদ্বয় তৎকালীন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হেতু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, সে কারণে বিচার নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখিত ষষ্ঠ কারণে বলা হয়, মামলাটি পুরোনো হওয়ায় পুলিশ অফিসারদের অনেককেই অবসরের কারণে ট্রেস করা যাচ্ছে না। ফলে চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম সমাপ্ত করে বিচার নিষ্পত্তির তালিকায় গ্রহণ করা হয়নি। আর এর মাধ্যমে মাননীয় আপিল বিভাগের নির্দেশনার অনিচ্ছাকৃত ভঙ্গ হয়েছে, যা আপিল বিভাগ কর্তৃক আইনানুগ সদয় দৃষ্টিতে বিবেচনায় নেওয়ার নিবেদন করেছেন বিচারক।
অনিচ্ছাকৃত এ ত্রুটির জন্য আপিল বিভাগের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক এম আলী আহমেদ প্রতিবেদনের শেষাংশে বলেছেন, অবশিষ্ট ১১ সাক্ষীর প্রতি ইতিমধ্যে ২৬ নভেম্বর তারিখ ধার্য করে আবার অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও সমন ইস্যু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সাক্ষীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে বা অন্তত তাঁদের ওপর এ–সংক্রান্ত প্রসেস জারি হয়েছে মর্মে পুলিশ প্রতিবেদন পাওয়ামাত্রই মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ সমাপ্ত করে বিচার নিষ্পত্তির কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। মামলাটির বিচার নিষ্পত্তিতে আপিল বিভাগের নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালনের মাধ্যমে যত শিগগিরই সম্ভব প্রসেস জারিসংক্রান্তে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে সাক্ষীদের প্রতি প্রসেস জারির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার বিচার ছয় মাসের মধ্যে শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার আসামি আশীষ রায় চৌধুরীর জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। ফলে এই আসামিকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন বহাল থাকছে এবং তাঁর কারামুক্তিতে আইনগত কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী।
আজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন। আসামিপক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী পলাশ চন্দ্র রায়, সেলিম আশরাফ চৌধুরী ও এম হারুনুর রশীদ খান।