‘গণতন্ত্র সম্মেলনে’ বাংলাদেশের অংশগ্রহণ কেন জরুরি

  • মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা ঢাকাকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সম্ভবত এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ পাচ্ছে না।

  • সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও মৌলিক অধিকার—এ তিন ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি অবনমিত হয়েছে।

  • দেশের বাইরে গণতন্ত্র এগিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্রের যে তাগিদ, দেশের ভেতরে সেই একই কাজে তেমন তাগিদের বড়ই অভাব।

প্রথম গণতন্ত্র সম্মেলনে কথা বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসে

২৯-৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ডাকা দ্বিতীয় ‘গণতন্ত্র সম্মেলন’। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া এ সম্মেলনের সহ-আয়োজক কোস্টারিকা, নেদারল্যান্ডস, জাম্বিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া। সম্মেলনের প্রথম পর্ব ভার্চ্যুয়াল, অর্থাৎ অনলাইনে, যাঁর যাঁর দেশে বসেই বিশ্বনেতারা আলোচনায় বসবেন। দ্বিতীয় পর্বে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সহ-আয়োজক দেশে সশরীর ও ভার্চ্যুয়াল অংশগ্রহণের মাধ্যমে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। বিশ্বনেতারা ছাড়াও সুশীল সমাজ ও ব্যক্তি খাতের প্রতিনিধিরাও এতে অংশ নেবেন।

কারা এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেলেন, তা নিয়ে বিস্তর জল্পনাকল্পনা চলছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রথম গণতন্ত্র সম্মেলনে ১১০টি দেশ আমন্ত্রণ পেয়েছিল। বাংলাদেশ সেই তালিকায় ছিল না। এবারও বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পাচ্ছে না বলে শোনা যাচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, আমন্ত্রিতদের তালিকা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। গত সপ্তাহে এক লিখিত বার্তায় পররাষ্ট্র দপ্তর এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, এ তালিকা সম্বন্ধে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।

বিশ্বের গণতন্ত্রমনা দেশগুলো যদি নিজেদের মধ্যে সাধারণ সম্মতির ভিত্তিতে একটি অভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণে সক্ষম হয়, তাতে আখেরে গণতন্ত্রেরই লাভ হবে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা অবশ্য ঢাকাকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সম্ভবত এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ পাচ্ছে না। গত মাসে ঢাকা ঘুরে গেছেন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে। তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের উপদেষ্টাও। ডেরেক শোলে জানিয়েছেন, প্রথম সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশসমূহের কাছে গণতন্ত্র সমুন্নত করতে তারা কী কী পদক্ষেপ নেবে, তার ‘প্ল্যান অব অ্যাকশন’ বা প্রত্যক্ষ কর্মসূচি চাওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ তেমন কোনো কর্মসূচি প্রদান করেনি।

১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক মতবিনিময় সভায় ডেরেক শোলে জানান, এবার না গেলেও ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আমন্ত্রিত হবে না, এমন নয়। গণতন্ত্রের প্রসার ও উন্নয়ন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অন্যতম প্রধান কৌশলগত অগ্রাধিকার। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রসারে যুক্তরাষ্ট্র তার সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে বলে এই মার্কিন কর্মকর্তা আশ্বাস দেন।

লিখিত অঙ্গীকার

শুধু মুখের কথা নয়, গণতন্ত্র প্রসারে অংশগ্রহণকারী দেশসমূহ হাতে–কলমে কী ব্যবস্থা নেবে, প্রথম সম্মেলনের আগে-পরে তারা সুনির্দিষ্ট ও লিখিত প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গণতন্ত্রের উন্নয়ন, দুর্নীতি দমন, কর্তৃত্ববাদ প্রতিরোধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোট ৭৫০টির মতো অঙ্গীকার পাওয়া গেছে। অংশগ্রহণকারী দেশের মধ্যে ৬৩টি দেশ লিখিত অঙ্গীকার প্রকাশ করেছে। আরও অঙ্গীকার আসছে বলে পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে।

সুনির্দিষ্ট বলা হলেও যে অঙ্গীকার তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, তা অংশগ্রহণকারী দেশসমূহের সদিচ্ছার প্রকাশ ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এই অঙ্গীকার সত্যি সত্যি পালিত হলো কি না, তা নির্ধারণের বা নজরদারির কোনো প্রক্রিয়া নেই।

ফলে মুখে বা লিখিতভাবে ঘোষিত অঙ্গীকার কাগুজে কথা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। যেমন পোল্যান্ড বা ইসরায়েল, যেখানে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা প্রকট হয়ে উঠছে, তারাও গণতন্ত্র প্রসারে কী ব্যবস্থা নেবে, তার ফিরিস্তি দিয়েছে। এ দুই দেশেই বিচারব্যবস্থা ক্ষমতাসীন মহলের আক্রমণের শিকার, যদিও মুক্ত বিচারব্যবস্থা এ সম্মেলনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। পোল্যান্ড নিজের দেশে নয়, প্রতিবেশী বেলারুশে কীভাবে গণতন্ত্র সমুন্নত করা যায়, তা নিয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রও আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ—এই দুভাবে অঙ্গীকারের দীর্ঘ তালিকা প্রদান করেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক অবকাঠামো, বিশেষত তথ্যব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তি, দুর্নীতি দমন ও মানবাধিকার সমুন্নয়নে নিয়োজিত ব্যক্তি ও সংস্থার প্রতি সমর্থনকল্পে মোট ৫০ কোটি ডলার ব্যয়ের আগাম ঘোষণা করেছে সে। তবে কংগ্রেস এ অর্থ বরাদ্দ অনুমোদন করলেই তা ব্যবহারের জন্য পাওয়া যাবে।

অংশগ্রহণের মাপকাঠি

ঠিক কোন কোন কারণে সম্মেলনে কোন দেশ আমন্ত্রিত অথবা আমন্ত্রিত নয়, তা জানতে চাওয়া হলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর সুনির্দিষ্ট কিছু জানায়নি। প্রথম সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের তালিকা দেখেই বোঝা সম্ভব বস্তুত কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে ‘গেস্ট লিস্ট’ তৈরি করা হয়নি।

যেমন এশিয়া থেকে ভারত ও পাকিস্তান ছিল, কিন্তু বাংলাদেশ নেই। উদারনৈতিক হিসেবে বিবেচিত মার্কিন থিঙ্কট্যাংক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন বিভিন্ন উপাত্তের ভিত্তিতে প্রস্তুত এক সম্মেলন-উত্তর বিশ্লেষণে বলেছে, সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও মৌলিক অধিকার—এ তিন ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি অবনমিত হয়েছে। পাকিস্তানের অবস্থাও ভিন্ন কিছু নয়। একই কথা ভারত সম্বন্ধেও, যদিও তারা উভয়েই এ সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়েছিল। ব্রুকিংস মনে করে, ভারসাম্য রক্ষার খাতিরেই ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশকেই ডাকা হয়।

অন্যদিকে, ইউরোপ থেকে হাঙ্গেরি ও তুরস্ককে আমন্ত্রণ না জানালেও পোল্যান্ড আমন্ত্রিত হয়। এ দুই দেশে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা বাড়ছে তা ঠিক, কিন্তু সে কথা পোল্যান্ডের বেলাতেও খাটে। ব্রুকিংস মনে করে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থানের জন্যই পোল্যান্ড আমন্ত্রণ পেয়েছে। অন্য কথায়, হিসাবটা রাজনৈতিক, মার্কিন স্বার্থের বিষয়টিই সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র নিজেই যেখানে ‘গণতন্ত্র ঘাটতি’তে ভুগছে, সেখানে এমন একটি সম্মেলন আয়োজন তার পক্ষে কতটা যুক্তিযুক্ত, সে কথাও উঠেছে। গণতন্ত্র, বিচার ও নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং আইনের শাসন—এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পিছু হটেছে। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় এক নিবন্ধে এরন ডেভিড মিলার ও রিচার্ড সকোলস্কি মন্তব্য করেন, দেশের বাইরে গণতন্ত্র এগিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্রের যে তাগিদ, দেশের ভেতরে সেই একই কাজে তেমন তাগিদের বড়ই অভাব। এই দুই ভাষ্যকার মনে করেন, যত না গণতন্ত্রের প্রসার এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য, তার চেয়ে বেশি চীন ও রাশিয়াকে একঘরে করা।

এ কথার অর্থ এই নয় এমন একটি সম্মেলনের কোনো গুরুত্ব নেই। ঠিক উল্টো, বিশ্বের গণতন্ত্রমনা দেশগুলো যদি নিজেদের মধ্যে সাধারণ সম্মতির ভিত্তিতে একটি অভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণে সক্ষম হয়, তাতে আখেরে গণতন্ত্রের লাভ বৈ লোকসান নয়। পশ্চিমা দৃষ্টিতে যেসব দেশ ঠিক গণতান্ত্রিক নয়, যেমন রাশিয়া বা চীন, তাদেরও এমন একটি প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়া দরকার। কারণ, এ দুই পরাশক্তিকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের বৈশ্বিক মানচিত্র বদলানো সম্ভব নয়।

তুলনা হিসেবে জলবায়ু সম্মেলনের কথা ভাবা যাক। বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে একটি অভিন্ন কর্মসূচি যদি বাস্তবায়িত করতে হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেই সব দেশের সমর্থন, যারা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে। এমনকি তারা যদি স্বাক্ষরিত কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে ব্যর্থ অথবা অনাগ্রহী হয়, তাহলেও তাদের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। এমন বৈশ্বিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা যার যার দেশের নাগরিক গোষ্ঠীর। এ কর্মসূচির উদাহরণ তুলে তারা নিজেদের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে।

গণতন্ত্র সম্মেলন ও বাংলাদেশ

এ সম্মেলনে বাংলাদেশ কেন আমন্ত্রিতদের তালিকায় নেই, সে প্রসঙ্গে ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, এ অনুপস্থিতি মোটেই বিস্ময়কর নয়। এই প্রতিবেদককে এ লিখিত বার্তায় তিনি জানিয়েছেন, সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানোয় বাইডেনের প্রশাসনের নিজস্ব কারণ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এ সিদ্ধান্তের ভেতর দিয়ে ওয়াশিংটন বাংলাদেশকে এ বার্তা দিতে পারে যে গণতন্ত্র প্রশ্নে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থানে সে মোটেই খুশি নয়। সে চায় এ অবস্থার পরিবর্তন হোক।’

তবে পাশাপাশি এ–ও ঠিক, বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হলে তাকে গণতান্ত্রিক সংস্কারে উৎসাহিত করা হবে। কুগেলম্যান এ দুই বিপরীতমুখী নীতিকে ‘ক্যারট অ্যান্ড স্টিক পলিসি’ (যুগপৎ ভয় ও প্রলোভন দেখানোর কৌশল) নামে অভিহিত করেছেন। ওয়াশিংটন যে গণতন্ত্র প্রশ্নে বাংলাদেশের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে আগ্রহী, এ আমন্ত্রণের মধ্য দিয়ে সে কথা জানানো হবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য উল্টো ফলের সম্ভাবনা রয়েছে। গণতন্ত্র প্রশ্নে পিছু হটা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অংশগ্রহণ হবে তাকে পুরস্কৃত করা।

এ কথা ঠিক, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বিচারব্যবস্থা ও আইনের শাসন নির্মাণে বাংলাদেশ ক্রমে পিছিয়ে পড়ছে। কিন্তু মুখে, সরকারি ঘোষণায় গণতন্ত্রের প্রতি তার অঙ্গীকারের কমতি নেই। এমনকি বাংলাদেশ এমন কথাও বলছে, অগ্রসর গণতন্ত্রের পশ্চিমা দেশগুলোও তার কাছ থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা শিখতে পারে। তাই যদি হয়, তাহলে তাকে এমন সম্মেলনে তো অবশ্যই ডাকা উচিত। এতে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশের কী লাভ হবে জানি না, কিন্তু বাংলাদেশের ভেতরে যেসব ব্যক্তি ও সংস্থা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে কাজ করছে, তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতি যেকোনো আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকারকে তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে ব্যবহার করতে পারে। ঠিক এ কারণে গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ।