জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর দাম চড়া, প্রজনন স্বাস্থ্যে প্রভাব কী

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

দেশে জন্মনিরোধক বড়ি ও কনডমের দাম বেড়েছে। কনডমের দাম ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেড়ে গেছে। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে কনডমের বিক্রি কমে গেছে। যদিও বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তাদের সরবরাহ তেমন কমেনি।

জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত বেড়ে যাওয়া এবং যৌন রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন জনসংখ্যা ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা। তাঁদের পরামর্শ, সরকারিভাবে এখন এসব সামগ্রী আরও সহজলভ্য করতে হবে।

দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারের হার এখন প্রায় ৫২ শতাংশ। আধুনিক পদ্ধতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় মুখে খাবার বড়ি বা পিল। এরপর আছে ইনজেকশন ও কনডম। সরকার বিনা পয়সায় জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী সরবরাহ করে। তবে তাদের এসব সামগ্রী বেশি চলে গ্রামাঞ্চলে। শহরে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে তা সরবরাহ করা হয় বলে জানান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (উপকরণ ও সরবরাহ) মো. হুমায়ুন কবির তালুকদার।

জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর জন্য বেশির ভাগ মানুষ ওষুধের দোকানগুলোর ওপর নির্ভর করেন। মুখে খাওয়ার বড়ির ৪৫ ভাগ ও কনডমের ৬২ শতাংশই সরবরাহ করে সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি (এসএমসি)। এ কোম্পানির মুখের বড়ির মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলা ফেমিকনের দাম ৩৪ টাকা ৫৮ পয়সা থেকে ৪০ টাকা হয়েছে বলে খুচরা দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেছে। এসএমসির সাতটি ব্র্যান্ডের কনডম আছে। এর মধ্যে প্যানথারের দাম প্যাকেটে ১৫ টাকা থেকে বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে। সেনসেশনের দাম প্যাকেটে ২৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০ টাকা। অন্য একটি কোম্পানির কনডম ক্যারেক্সের দাম প্যাকেটপ্রতি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা হয়েছে।

রাজধানীর তেজতুরী বাজারের আল-দাওয়া ফার্মেসির বিক্রেতা জোবায়েরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিক্রির দিক থেকে প্যানথারের চাহিদা বেশি। এরপরই আছে সেনসেশন। দুটিরই দাম বেড়েছে। অন্য ব্র্যান্ডগুলোরও দাম বাড়বে বলে জানতে পেরেছি।’

দাম বেড়ে যাওয়ায় পর খাবার বড়ির চাহিদা না কমলেও কনডমের বিক্রি কমেছে বলে জানান জোবায়েরুল ইসলাম। তাঁর মতো রাজধানীর মনিপুরীপাড়ার রোজারিও ফার্মেসির বিক্রেতা শামস জানান, কনডমের বিক্রি দিন দিন কমছে। এই বিক্রেতা বলছিলেন, যেসব কনডমের দাম কম, সেগুলোরই দাম বেড়েছে। তাই মানুষ এসব কিনছে না।

দুই বিক্রেতারই ধারণা, দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে মানুষ বাধ্য হয়েই জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তবে এভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করেন জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট ডা. আবু সাইদ মো. হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। এসব সামগ্রী সুলভে না পাওয়া গেলে মানুষ প্রথাগত ব্যবস্থা বেছে নেবে। সে ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বাড়তে পারে।

ডা. আবু সাইদ মো. হাসান জানান, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ক্ষেত্রে ৫০ ভাগ গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। আর এসব গর্ভপাত যদি অপ্রশিক্ষিত কারও হাতে হয়, তবে নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকির সৃষ্টি হয়। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। বাংলাদেশে ২০১০ সালে গর্ভকালীন মৃত্যুর হার ছিল ১ শতাংশ। তবে ২০১৬ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ শতাংশ। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাতের কারণেই এসব মৃত্যু হয়েছিল।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কিন্তু কমে এসেছে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৬৪। ২০২২ সালে এই বৃদ্ধির হার কমে হয়েছে ১ দশমিক ২২। তবে সাম্প্রতিক কিছু প্রবণতা জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অগ্রগতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। ২০২১ সালের বাংলাদেশ আরবান হেলথ সার্ভেতে দেখা গেছে, মোট প্রজনন হার (টিএফআর) ২০১৩ সালের তুলনায় সিটি করপোরেশনগুলোর আওতাধীন বস্তি, বস্তির বাইরে এবং অন্যান্য শহর এলাকায় বেড়েছে। তবে এ সময় বস্তির বাইরে কিশোরী বয়সী ১৫ থেকে ১৯ বছরের মায়েদের গর্ভধারণের হার ৭ শতাংশ বেড়েছে।

শহর অঞ্চলে বস্তির বাইরে সরকারের জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি তেমন জোরালো নয়। জরিপটি হয়েছিল ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত। সে সময় করোনার ব্যাপক সংক্রমণ ছিল। করোনাকালে দেশে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার একটি প্রবণতা দেখা গেছে। তারপরও গর্ভধারণের এই উচ্চ হারকে উদ্বেগজনক বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কিশোরী গর্ভধারণ ও টিএফআর বৃদ্ধির এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বিষয়টি উদ্বেগজনক। এর মধ্যে আবার জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর উচ্চ মূল্য এবং এর কারণে ব্যবহারে অনীহা দেখা দিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।

বিশ্বজুড়ে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। এরই মধ্যে দেশে বেড়েছে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর দাম। বর্তমান বাস্তবতায় জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর দাম বাড়াতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছেন বলে জানান এসএমসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তসলমি উদ্দিন খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দাম না বাড়িয়ে উপায় ছিল না। তবে দাম বাড়লেও আমাদের সামগ্রীর চাহিদা কমেনি।’

বিক্রেতারা অবশ্য বলছেন, স্বল্প আয়ের মানুষেরা যেসব সামগ্রী কিনতেন সচরাচর সেগুলোরই বিক্রি কমেছে।

অর্থনৈতিক সংকটের এ সময়ে দাম বৃদ্ধির ফলে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর ব্যবহার কমবে বলেই মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ওবায়দুর রব। তিনি বলেন, এর ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বাড়বে। তাই এখন সুলভ মূল্যে এসব সামগ্রী দেওয়ার ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে।

সরকারি জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী সাধারণত পাওয়া যায় হাসপাতালে বা শহরাঞ্চলের ক্লিনিকগুলোয়। শহরের বেশির ভাগ মানুষ এসব সামগ্রীর জন্য ওষুধের দোকানের ওপর নির্ভর করেন। সরকারের দলিল জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ অনুযায়ী, জন্মনিরোধকসামগ্রী ব্যবহারে বেসরকারি খাত দিন দিন বড় হচ্ছে। দেশের ৪৫ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবহারকারী ফার্মেসি থেকে এসব সামগ্রী কেনেন। সরকার দেয় ৪৪ শতাংশ আর ৫ শতাংশ এনজিও।

ওই জরিপ অনুসারে, বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদা, অর্থাৎ দরকার থাকলেও প্রয়োজন অনুসারে না পাওয়ার হার ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরী মায়েদের মধ্যে সাড়ে ১৫ শতাংশ। এর গড় হার ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ১২ শতাংশ। এই অপূর্ণ চাহিদা যাঁদের বেশি, তাঁদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়াটা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন জনসংখ্যাবিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই সংকটের সময়ে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর প্রাপ্যতা, সহজলভ্যতা ও সেগুলোর মান নিশ্চিত করতে হবে। এর দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।