সরকারি চাকরিতে নারী কোটা রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন নাগরিক ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি এবং গবেষক ও শিক্ষাবিদেরা। তাঁরা মনে করছেন, এখনো চাকরিতে নারী ও পুরুষের অংশগ্রহণ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ পরিস্থিতিতে নারীদের কোটা একেবারেই না থাকলে এ বৈষম্য আরও বাড়বে।
কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, চাকরিতে এখনই নারীদের কোটা চালু না করে কিছুদিন দেখা যেতে পারে। বৈষম্য না কমে এলে নারীদের জন্য কোটা আবার চালু করা যেতে পারে।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় গত রোববার সামগ্রিকভাবে বাতিল (রদ ও রহিত) করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। পাশাপাশি মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ অন্যদের জন্য বাকি ৭ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে। রায়ে অবশ্য আদালত বলেছেন, এই নির্দেশনা ও আদেশ সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজনে ও সার্বিক বিবেচনায় নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে।
গতকাল সোমবার রাতে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ অন্যদের জন্য বাকি ৭ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন অনুমোদন করেছে সরকার।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কোটাব্যবস্থার মতো নীতিনির্ধারণী বিষয় সরকারের এখতিয়ার রয়েছে। আদালতের রায়েও বিষয়টি এসেছে। তাই কোটার বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে নারীদের কোটা সংরক্ষণের সুযোগ আছে, আর সেটি প্রয়োজনীয়ও।
২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ দশমিক ৪৯ শতাংশ নারী আর ৪৯ দশমিক ৫১ শতাংশ পুরুষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এর অর্থ হলো দেশে প্রতি ১০০ জন নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা ৯৮। দেশের জনসংখ্যায় নারীর সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। ২০১১ সালের জনশুমারিতে নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে দুই লাখ কম ছিল। এখন পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেড়েছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ছেলেদের চেয়ে মেয়েশিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। উচ্চশিক্ষায় নারী ও পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। তবে সরকারি চাকরিতে নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা এখন দ্বিগুণের বেশি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, দপ্তর, করপোরেশন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সাড়ে ১৪ লাখের বেশি কর্মচারী কর্মরত। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৪ লাখ ৯ হাজার ৬৮। আর পুরুষ ১০ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫০ জন।
২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে (নবম থেকে ১৩তম গ্রেড) ৫৬ শতাংশ নিয়োগ হতো কোটার মাধ্যমে। এর মধ্যে নারীদের জন্য ছিল ১০ শতাংশ কোটা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আমিনুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে নারী কোটা এখনো প্রাসঙ্গিক। তবে আমি আমার নিজের বিভাগের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, নারীরা মেধায় পিছিয়ে নেই। আমার বিভাগে দেখেছি, মেয়েরা কিন্তু ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে থাকে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর চাকরির পরীক্ষা—দুটো ভিন্ন বিষয়। চাকরিতে নানা কারণে মেয়েদের অংশগ্রহণ এখনো কম। এ জন্য সরকারি চাকরিতে যৌক্তিক বিবেচনায় নারী কোটা রাখা উচিত।’
অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আমিনুজ্জামান মনে করেন, এখনই নারী কোটা তুলে দেওয়ার সময় আসেনি। চাকরিতে নারী-পুরুষের যে বৈষম্য আছে, তা কমলেই কেবল এ কোটা তুলে দেওয়া যেতে পারে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম মনে করেন, শুধু সরকারি চাকরিতে নয়, সমাজের প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীরা সুযোগ কম পান। তাঁদের যথার্থ মূল্যায়নও হয় না। এটা যেমন সমাজে, তেমনি পরিবারেও। যদিও মেধায় নারীরা মোটেও পিছিয়ে নেই বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ। তাঁর কথা, ‘তবে এই মুহূর্তেই চাকরিতে নারী কোটা দিতে হবে, এমনটা না। কোটা ছাড়া কিছুদিন দেখা যেতে পারে। তারপরও যদি দেখা যায় বৈষম্য বাড়ছে, তখন কোটা নির্ধারণ করা যেতে পারে।’
সরকারি চাকরিতে থাকা নারীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে যথার্থ মূল্যায়ন করা হয় না বলে মনে করেন অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম। তিনি বলেন, সেই বৈষম্যও কমানো দরকার।
সরকারি চাকরিতে নারীদের জন্য কোটা বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও নাগরিক সংগঠন। গতকাল আলাদা বিবৃতি দিয়ে তারা এ দাবি জানিয়েছে।
নারী কোটা বাদ দেওয়ার বিষয়ে দেশের ৬৬টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি গভীর বিস্ময় প্রকাশ করেছে। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলোর (এসডিজি) একটি হলো নারী-পুরুষের সমতা। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে নারী কোটা অবশ্যই প্রয়োজন। সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে এ বিবৃতি দেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম।
শিক্ষক, অধিকারকর্মী, নারী সংগঠনের ২৫ প্রতিনিধি এক বিবৃতিতে নারীদের জন্য কোটা বহালের পক্ষে মত দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোটার সুষ্ঠু বণ্টন করতে হবে। যেখানে নারী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ও লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যের মানুষের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে আছেন গবেষক রেহনুমা আহমেদ, মাহা মির্জা প্রমুখ।
সরকারি চাকরিতে সর্বস্তরে নারী কোটা যৌক্তিক অনুপাতে বহাল রাখার দাবি করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নারী সেল ও সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম।