রিকশাচিত্র আঁকা নতুন প্রজন্মকে শিখিয়ে যেতে চাই

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ঢাকা শহরের ‘রিকশা ও রিকশাচিত্র’। ৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সেটা ঘোষণা করা হয়। এই রিকশাচিত্র হারিয়ে যেতে বসেছিল। তবে এখন রিকশার পাশাপাশি রোদচশমা, ব্যাগ, জুতা ও ঘর সাজানোর নানা উপকরণে রিকশাচিত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছে। রিকশা এবং রিকশার বাইরে রিকশাচিত্র যাঁরা জনপ্রিয় করেছেন, তাঁদের একজন পুরান ঢাকার শিল্পী মোহাম্মদ হানিফ পাপ্পু। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাসান ইমাম

প্রশ্ন

খবরটা শুনে কেমন লাগছে?

হানিফ পাপ্পু: ইউনেসকোর স্বীকৃতির বিষয়টা! খুবই ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, এই অর্জনের মাধ্যমে শিল্পটি প্রাণে বেঁচে যাবে।

প্রশ্ন

আপনি মনে হচ্ছে আগে থেকে জানতেন।

হানিফ পাপ্পু: হ্যাঁ। বাংলা একাডেমির সুলতান ভাই (ফোকলোর বিভাগের আমিনুর রহমান সুলতান) ফ্রান্স থেকে ফেরার পর জানিয়েছিলেন, ডিসেম্বর মাসে এই স্বীকৃতি আসতে পারে।

প্রশ্ন

আপনি বলছিলেন, স্বীকৃতির মাধ্যমে শিল্পটি প্রাণে বেঁচে যাবে। এভাবে বলছেন যে?

হানিফ পাপ্পু: এখন তো রিকশাচিত্রের সেই রমরমা দিন নাই। একটা সময় দিন নেই, রাত নেই, শুধু এই কাজ করতাম। খাওয়ার সময়ও পেতাম না। এখন কাজ কম।

প্রশ্ন

আপনি এই পেশায় এলেন কবে?

হানিফ পাপ্পু: সে তো মুক্তিযুদ্ধের আগেই। আমার বয়স তখন খুবই কম। মামা (মো. রফিক) কাজ করতেন ফিল্ম (চলচ্চিত্র) ব্যানার আর্টিস্ট হিসেবে। একদিন বাসা থেকে মামার খাবার নিয়ে গিয়ে দেখি ছবি তিনি আঁকছেন। ছবি দেখে আঁকার প্রেমে পড়ে গেলাম। মামাকে বললাম, শিখতে চাই। মামা তখন গ্রিন বাবুকে (মামার সহকর্মী) বললেন, ওকে শিখিয়ে দে। গ্রিন বাবু আমার গুরু।

প্রশ্ন

সেটা কত আগের কথা?

হানিফ পাপ্পু: এই ১৯৬৮/৬৯ সালের দিকের কথা। তারপর তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধের পর গ্রিন বাবু আর সুভাষ বাবু মিলে পুরান ঢাকায় রূপায়ণ আর্ট পাবলিসিটি নামে একটা কারখানা দিলেন। আমি সেখানে আর্টিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করলাম।

প্রশ্ন

সিনেমার ব্যানার থেকে কীভাবে রিকশার বোর্ড আঁকা শুরু করলেন?

হানিফ পাপ্পু: সিনেমা যখন হিট (জনপ্রিয়তা পাওয়া) হতো; সেই সিনেমার ছবি আঁকার জন্য রিকশার মালিকেরা এসে অর্ডার দিতেন। একসঙ্গে ১০০ থেকে ৫০০ বোর্ড আঁকার অর্ডার আসত।

প্রশ্ন

একেকটি বোর্ডে রিকশাচিত্র আঁকতে কত টাকা পেতেন?

হানিফ পাপ্পু: এই ধরেন ৩০ থেকে ৪০ টাকা।

প্রশ্ন

আর এখন?

হানিফ পাপ্পু: রিকশার মালিকদের জন্য এক রকম দাম। শৌখিন কারও জন্য আরেক রকম দাম। ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায় রিকশামালিকেরা আঁকাতে পারেন। কারণ, তাঁরা একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ দেন। অন্যরা একটা-দুইটা আঁকালে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকাও নিই।

প্রশ্ন

মাসে আয় কত?

হানিফ পাপ্পু: কোনো মাসে আয় ১০ হাজার টাকা, কোনো মাসে ৫০ হাজার।

প্রশ্ন

রমরমা অবস্থা এখন নেই। তাহলে এই পেশায় টিকে আছেন কীভাবে?

হানিফ পাপ্পু: পাগলামি করে (হাসি)। ২০০০ সালের পর থেকেই তো সিনেমার ব্যানার ডিজিটালের হাতে চলে যায়। তখন আমি ভিন্ন মাধ্যমে এই শিল্পকে নিয়ে কাজ শুরু করি। হারিকেন, গ্লাস, সানগ্লাসের (রোদচশমা) মতো নানা কিছুতে রিকশা আর্ট শুরু করি। অনেকে বলত, পাগল হয়ে গেছি। তবে এখন কিন্তু এই মাধ্যমেই রিকশা আর্টের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি।

প্রশ্ন

আপনি তো রিকশাচিত্র নিয়ে দেশের বাইরেও গেছেন?

হানিফ পাপ্পু: হ্যাঁ। ২০১৩ সালে ডেনমার্ক এবং ২০২২ সালে জার্মানি গিয়েছিলাম রিকশাচিত্র নিয়ে।

প্রশ্ন

আপনার পরিবারে কে কে আছেন?

হানিফ পাপ্পু: স্ত্রী নাসিমা বেগম ও একমাত্র সন্তান আইরিন।

প্রশ্ন

এখন আপনার ইচ্ছা কী?

হানিফ পাপ্পু: ইউনেসকোর স্বীকৃতি পাওয়া গেছে। সরকারি বা বেসরকারি কেউ এখন রিকশা পেইন্ট নিয়ে একটা ইনস্টিটিউট করলে ভালো হয়। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের শিখিয়ে যেতে চাই নিজের জ্ঞান।