আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং স্থানীয় সরকারে নিকটজনদের বসিয়েছেন সংসদ সদস্য।
১৯৯৭ সাল থেকে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফতাব উদ্দিন সরকার। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে পরপর দুবার তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নীলফামারী-১ আসনের (ডোমার-ডিমলা) সংসদ সদস্য হয়েছেন। ২০১৯ সালে দলের ডিমলা উপজেলা কমিটির সর্বশেষ সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাঁর চাচাতো ভাই আনোয়ারুল হক সরকার।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর ‘বঞ্চিত অংশের’ নেতারা বলছেন, দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ পদে যাঁরা আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকারের ভাই, ভাতিজাসহ আত্মীয়স্বজন। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পদেও রয়েছেন তাঁর পরিবারের সদস্যসহ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। এর বাইরে যাঁরা দলীয় রাজনীতি করেন, তাঁদের পদ–পদবি দেওয়া হয় না। উল্টো নানাভাবে হয়রানি করা হয় বলে ওই নেতাদের অভিযোগ।
২০০৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ডিমলা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন শৈলেন চন্দ্র রায়। এরপর ২০২১ সাল পর্যন্ত ছিলেন আহ্বায়ক। তবে দলীয় রাজনীতিতে এখন তিনি নিষ্ক্রিয়।
শৈলেন প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ৯ জুন উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সংসদ সদস্যের ভাতিজা ফেরদৌস পারভেজের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে ককটেল বিস্ফোরণ ও কার্যালয়ের সামনে থাকা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় ১৩ জুন শৈলেনসহ যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ২৮ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা দেন ফেরদৌস। একই দিন শৈলেনসহ ছাত্রলীগ-যুবলীগের ২৭ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগে আরেকটি মামলা দেন ফেরদৌসের বড় ভাই এ এইচ এম ফিরোজ সরকারের ব্যবসায়িক সহযোগী নুরনবী ইসলাম।
শৈলেনের দাবি, তিনি ‘এমপি লীগ’ করেন না। অর্থাৎ সংসদ সদস্যের অনুগত নন। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দেওয়া হয়েছে।
শৈলেনের সঙ্গে মামলা দুটিতে আরও যাঁদের আসামি করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্যসচিব ও উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার রায় এবং ডিমলা সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান।
এমপি লীগ না করায় মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন মিজানুর রহমান। উত্তম কুমার এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
দলীয় সূত্র জানায়, গত মার্চে অনুষ্ঠিত ডিমলা সদর ইউনিয়নের উপনির্বাচনে আফতাব উদ্দিনের ভাতিজা ফিরোজ সরকার চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ছিলেন। তখন মামলা তুলে নেওয়ার কথা বলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মমতাজুল হকের উপস্থিতিতে বিষয়টি মীমাংসা করা হয়।
মমতাজুলও সমঝোতা হওয়ার কথা জানান। তবে ভুক্তভোগী নেতা-কর্মীদের দাবি, মীমাংসার কথা বলা হলেও পরে মামলা তোলা হয়নি। উল্টো হত্যাচেষ্টা ও ছিনতাই মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
শৈলেনদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ভুল-বোঝাবুঝি থেকে এমন ঘটনা ঘটেছে। তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে বিষয়টি সমাধান করে দিয়েছেন।
গত বছরের ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসে ডিমলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা তবিবুল ইসলামকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ ওঠে সংসদ সদস্যের দুই ভাতিজা-ফেরদৌস ও উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আবু সায়েম সরকারের বিরুদ্ধে।
তবিবুল প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, জেলহত্যা দিবসে তিনি দলীয় কর্মসূচিতে পতাকা উত্তোলনের জন্য এগিয়ে গেলে ফেরদৌস ও সায়েম তাঁকে বাধা দেন। এ সময় উপস্থিত নেতা-কর্মীরা তাঁদের নিবৃত্ত করলেও পরে শোক মিছিলে অংশ নেওয়ার সময় তাঁকে লাঞ্ছিত করা হয়।
পারভেজ ও সায়েম অবশ্য দাবি করেন, তবিবুল জেলা পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর (জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন) পক্ষে মাঠে ছিলেন। সে কারণে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘আপনি আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট করে পার্টি অফিসে কেন?’
এ বিষয়ে আফতাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেরা তবিবুলকে বলেছিল, “ব্যানারের অগ্রভাবে থাকবেন না। কারণ, আপনি নৌকা মার্কার চেয়ারম্যান হয়ে দলের বিপক্ষে ভোট করেছেন।” এ নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা হয়েছিল।’
তবে জেলা পরিষদ নির্বাচনে কারও পক্ষে ভোট চাননি বলে দাবি করেন তবিবুল।
ডিমলা উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে সংসদ সদস্যের ভাই, ভাতিজাসহ অন্তত ১৯ স্বজন রয়েছেন। যেমন ছোট ভাই ইব্রাহিম কামাল সরকার ডিমলা সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি, ভগ্নিপতি মোজাম্মেল হক ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি, ভাগনে জাহাঙ্গীর আলম খগা খড়িবাড়ী ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি। সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন অবশ্য দাবি করেন, তাঁরা নিজ যোগ্যতায় এসব পদ পেয়েছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি উপজেলা কৃষক লীগের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন আবদুর রাজ্জাক। তিনি দলীয় রাজনীতিতে আফতাব উদ্দিনের বিপরীত পক্ষের।
কৃষক লীগের একাধিক নেতার অভিযোগ, ওই সম্মেলনে সংসদ সদস্যের ভাতিজা ফেরদৌস তাঁদের প্রতিবেশী মনিরুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক করতে চান। কিন্তু কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা দেন। এরপর ফেরদৌসের নেতৃত্বে একদল যুবক সম্মেলনমঞ্চে হামলা করেন।
যদিও ফেরদৌস দাবি করেন, কেন্দ্রীয় নেতারা দ্বিতীয় অধিবেশনে কাউন্সিল ঘোষণা দিয়ে কৌশলে দুপুরের খাবার বিরতির সময় সাধারণ সম্পাদকের নাম আহ্বান করেন। নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়টি তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। এতে কিছুটা হট্টগোল হয়।
আফতাব উদ্দিন সরকার হামলার বিষয়টি জানেন না বলে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন। তবে রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, সংসদ সদস্যের পরিবারের বাইরে ডিমলায় রাজনীতি করার সুযোগ কম। এ কারণে ওই সম্মেলনে হামলা হয়েছিল।
গত মার্চে ডিমলা সদর ইউনিয়নের উপনির্বাচনে আফতাব উদ্দিনের ভাতিজা ফিরোজ সরকার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর আগে সেখানে চেয়ারম্যান ছিলেন সংসদ সদস্যের ছোট ভাই আবুল কাশেম সরকার। ফিরোজ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক।
সংসদ সদস্যের আরেক ভাগনে জাহাঙ্গীর আলম খগা খড়িবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন। আজ সোমবার এই ইউনিয়নে ভোট। আজ খগা খড়িবাড়ীসহ ডিমলার যে তিনটি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন হবে, সেগুলোতে ইউনিয়ন সভাপতি পদাধিকারবলে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বলে জানান আফতাব উদ্দিন।
তবে খগা খড়িবাড়ী এলাকার বাসিন্দাদের ভাষ্য, দল না করেও গতবার নৌকার মনোনয়ন পেয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি পরাজিত হন। এরপর আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন কমিটিতে সভাপতি হন তিনি।
গত ইউপি নির্বাচনে নাওতোরা ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে নৌকার মনোনয়ন পেয়ে হেরে যান দলের ইউনিয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী সংসদ সদস্যের খালাতো ভাইয়ের ছেলে আশিক ইমতিয়াজ। সাইফুল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, সংসদ সদস্যের পরিবার তাঁর পক্ষে কাজ করেনি।
আফতাব উদ্দিনের ভাষ্য, সাইফুল দলকে বিভক্ত করেছেন। ওয়ার্ড কমিটিগুলো করতে দেননি। এ কারণে তিনি হেরেছেন।
স্থানীয় বঞ্চিত নেতা-কর্মীদের ভাষ্য, সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকার ডিমলায় দলীয় রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র কায়েম করেছেন। কেউ এর বিরোধিতা করলে তাঁকে কোণঠাসা করা হয়।