কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন, সক্ষমতা বাড়াতে সহযোগিতা স্মারক।
শুল্কবিষয়ক পারস্পরিক সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তি।
জাহাজভাঙা শিল্প খাতে সহযোগিতা স্মারক।
মেট্রোরেলের বিষয়ে সহযোগিতা স্মারক।
বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, তথ্যপ্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তাসহ আট চুক্তি ও সহযোগিতা স্মারক সই হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের দ্বিতীয় দিনে গতকাল বুধবার দুই দেশের মধ্যে এসব চুক্তি ও স্মারক সই হয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার শীর্ষ বৈঠক হয়।
প্রধানমন্ত্রীর টোকিও সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-জাপান বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘সমন্বিত অংশীদারত্ব’ থেকে ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ উন্নীত হলো।
দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর দেশের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।
জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের উপস্থিতিতে আট চুক্তি ও সহযোগিতা স্মারক সই হয়। কৃষি, মেট্রোরেল, শিল্পোন্নয়ন, জাহাজভাঙা শিল্প, শুল্কসংক্রান্ত বিষয়, মেধাসম্পদ, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, তথ্যপ্রযুক্তি ও সাইবার নিরাপত্তা সহযোগিতা বিষয়ে দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা চুক্তি ও সহযোগিতা স্মারকে সই করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী কিশিদা যৌথ বিবৃতি দেন।
বাংলাদেশ ও জাপান সরকারের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা-সংক্রান্ত স্মারক সইয়ের ফলে প্রতিরক্ষা সংলাপ, সফর বিনিময়, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কোর্স, সেমিনার, কর্মশালা, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক অন্য কোনো সম্মত কার্যক্রমের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার হবে।
জাপানের ভূমি, অবকাঠামো, পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সহযোগিতা স্মারক সই হয়েছে। এর ফলে মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে সহযোগিতা, মেট্রোরেল নীতি, আইন ও প্রবিধান বিষয়ে সহযোগিতা, অবকাঠামো, রোলিং স্টক ও সিস্টেমের জন্য প্রযুক্তি; নিরাপত্তানীতি ও ব্যবস্থাপনা এবং দুর্যোগ প্রতিরোধব্যবস্থার ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়বে।
বাংলাদেশ-জাপানের মধ্যকার বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘ব্যাপক অংশীদারত্ব’ থেকে সফলভাবে ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ পৌঁছেছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কিশিদার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আদ্যোপান্ত আলোচনা করেছি। আমরা খুব খুশি যে দুই দেশের বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে সমন্বিত অংশীদারত্ব থেকে কৌশলগত অংশীদারত্বে উন্নীত করতে পেরেছি।’
গতকাল টোকিওতে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজ প্রধানমন্ত্রী কিশিদা এবং আমি কৌশলগত অংশীদারত্বের ওপর যৌথ বিবৃতি দিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের দুই দেশের জনগণ ও সরকারের মধ্যে বিদ্যমান চমৎকার বোঝাপড়া, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা সামনের দিনগুলোতে আরও জোরদার হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দুই পক্ষে কৃষি, শুল্কসংক্রান্ত, প্রতিরক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও সাইবার নিরাপত্তা, শিল্পোন্নয়ন, মেধাসম্পদ, জাহাজ রিসাইক্লিং এবং মেট্রোরেল বিষয়ে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, ভবিষ্যৎ সহযোগিতার ক্ষেত্রে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে।’
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উভয় পক্ষ রোহিঙ্গা ইস্যুর পাশাপাশি মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ (এমআইডিআই) এবং বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (বিগ-বি) অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব নিয়ে আলোচনা করে।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের প্রতি জাপানের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত।
শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে কক্সবাজারে স্থানীয় জনগণের জীবন ও জীবিকার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে তাদের যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার জন্য জাপানকে অনুরোধ জানিয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলতি বছরেই ঢাকা-নারিতা সরাসরি বিমান চলাচল শুরু হতে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, তাঁরা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে এমআইডিআই এবং বিগ-বি উদ্যোগ গ্রহণ এবং বঙ্গোপসাগর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর যোগাযোগ স্থাপনের বিষয় নিয়েও আলোচনা করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার হওয়ায় আমরা জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা জাপানের সঙ্গে আগামী দিনগুলোতে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি সম্পন্ন করার অপেক্ষায় আছি।’
জাপানের প্রধানমন্ত্রী কিশিদা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর দেশের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশ ও জাপান তাদের সম্পর্ককে কৌশলগত অংশীদারত্বে উন্নীত করেছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় এক মিলিয়ন বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিকে আশ্রয় দিয়েছে এবং আমরা বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে সমর্থনদান অব্যাহত রাখব।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শেষে এক যৌথ বিবৃতিতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, উভয় দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গভীর করতে এবং আন্তর্জাতিক মহলে সহযোগিতা সম্প্রসারণে কাজ করবে।
কিশিদা বলেন, বৈঠকে উভয়েই কৌশলগত অংশীদার হিসেবে আইনের শাসনের ওপর ভিত্তি করে অবাধ ও উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা বজায় রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, যখন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, গত মাসে ঘোষিত অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক পয়েন্টের নতুন পরিকল্পনার ভিত্তিতে দুই দেশ ব্যাপক ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করতে সম্মত হয়েছে।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেশ এবং একটি আকর্ষণীয় বিনিয়োগ গন্তব্য। তাই টোকিওর প্রত্যাশা, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা ও বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল জাপানের সম্রাট নারুহিতোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর উপ–প্রেস সচিব কে এম সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী ইম্পেরিয়াল প্যালেসে স্থানীয় সময় বেলা তিনটায় সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এদিকে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োশিমাসা হায়াশি, বাংলাদেশ-জাপান বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতাবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান, জাইকার প্রেসিডেন্ট, জেটরোর চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মৈত্রী সংসদীয় লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আকাসাকা প্যালেসে তাঁর সঙ্গে পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করেন।
এর আগে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ১৫ দিনের সরকারি সফরে গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা ছাড়েন। একই দিন স্থানীয় সময় বিকেল ৪টা ৪৫ মিনিটে টোকিওর হানেদা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। বিমানবন্দরে তাঁকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার আমন্ত্রণে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে জাপানে রয়েছেন শেখ হাসিনা। মহামারি কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার আগে ২০১৯ সালে সর্বশেষ জাপান সফর করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।