ভারতীয় মায়ের কাছে শিশুটি ফিরল দুই বছর পর, জামিন পেলেন বাবা

দুই বছর পর সন্তানের সঙ্গে মা সাদিকা শেখ
ছবি: সাদিকা শেখের সৌজন্যে

প্রায় দুই বছর পর সন্তানকে ফিরে পেলেন মা সাদিকা শেখ। শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ শিশুটির বাবা সানিউর টি আই এম নবীকে পাসপোর্ট জমা রাখার শর্তে জামিন দিয়েছেন।

প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ আজ সোমবার এ আদেশ দেন।

আদালতের আদেশ না মেনে শিশুটিকে নিয়ে দেশত্যাগ করায় আদালত অবমাননার মামলায় ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর এক আদেশে হাইকোর্ট সানিউকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করেন।

আইনজীবীর তথ্যমতে, এরপর শিশুটিসহ গত অক্টোবরে দেশে ফেরেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক সানিউর। ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করলে গত ২৩ অক্টোবর তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। আত্মসমর্পণের পর হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে আপিল বিভাগে জামিন চান তিনি। আবেদনটি ১ নভেম্বর শুনানির জন্য আপিল বিভাগে ওঠে। শিশুটিকে মায়ের কাছে হাস্তান্তর করা হয়েছে কি না, সেদিন জানতে চান আদালত। একই সঙ্গে ৬ নভেম্বর শুনানির জন্য দিন রাখেন।
এর ধারাবাহিকতায় আজ শুনানি হয়। দাদি ও ফুফুর সঙ্গে সকালে আদালতে আসে শিশুটি। শিশুটির মাও আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

আদালতে সানিউরের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মুন্সী মনিরুজ্জামান, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মো. মিনহাদুজ্জামান ও সাকিব রেজোয়ান কবীর। সাদিকার পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ, সঙ্গে ছিলেন কাজী মারুফুল আলম।  

শুনানিতে আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, শিশুটিকে নিয়ে আসা হয়েছে। এত দিন বাবার কাছে ছিল। আজ সকালে মায়ের কাছে দেওয়া হয়েছে। জামিনে (শিশুটির বাবা) আপত্তি নেই। তবে শিশু মায়ের কাছে থাকবে।

শুনানি নিয়ে শিশুটির বাবার করা আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। আদালত বলেন, শিশুটি তার মায়ের কাছে থাকবে। বাবা সপ্তাহে দুবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ১ পর্যন্ত শিশুটিকে দেখতে পারবেন এবং সময় কাটাতে পারবে, তবে নিয়ে যেতে পারবেন না। আদালতের অনুমতি ছাড়া শিশুটিকে দেশের বাইরে নেওয়া যাবে না। পারিবারিক আদালতে শিশুটির মায়ের করা মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সময়ের জন্য এ আদেশ দেওয়া হয়।

পরে শিশুটিকে নিয়ে আদালত কক্ষ থেকে বের হন সাদিকা। এ সময় তিনি শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না। দুই বছর পর আজ ওকে পেয়েছি, তাতে আমি খুব খুশি। এখন ওর বয়স পাঁচ বছর।’

ঘটনার পূর্বাপর

আইনজীবীদের তথ্যমতে, ভারতীয় মুসলিম পরিবারের মেয়ে সাদিকার সঙ্গে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক ব্যবসায়ী সানিউরের বিয়ে হয় ২০১৭ সালের ৪ জুলাই হায়দরাবাদে। ২০১৮ সালে এই দম্পতির ছেলেসন্তান হয়। সানিউরের বিরুদ্ধে সাদিকাকে মারধরের অভিযোগ ওঠে। সাদিকা ও শিশুটি তখন সানিউরের বাসায় ছিল।

মারধরের বিষয়টি জানাজানির পর সন্তানসহ সাদিকাকে আটক রাখা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ২০২১ সালের ৮ আগস্ট রিট করেন। সানিউর ওই বছরের ১১ আগস্ট সাদিকাকে বিবাহবিচ্ছেদের নোটিশ পাঠান। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ৯ আগস্ট হাইকোর্ট আদেশ দেন। ২৬ আগস্ট মাসহ শিশুকে হাজির করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। হাজিরের পর সেদিন আদালত শিশুকে মায়ের কাছে দিয়ে বাবাকে সপ্তাহে তিন দিন দেখা করার সুযোগ দেন।   

হাইকোর্টের আদেশের পর সানিউরের খরচে গুলশান ক্লাবে শিশুটিসহ সাদিকার থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সানিউর সপ্তাহে তিন দিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত শিশুটিকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান। তবে ২০২১ সালের ১৩ নভেম্বর সানিউর শিশুটিকে নিয়ে যাওয়ার পর আর ফেরত দেননি।

বিষয়টি জানানো হলে হাইকোর্ট শিশুটিকে রিট আবেদনকারীদের আইনজীবীর চেম্বারে মায়ের কাছে হস্তান্তর করতে বলেন। এরপরও শিশুটিকে হাজির না করার বিষয়টি জানানোর পর ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর হাইকোর্ট শিশুটিকে নিয়ে সানিউরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন। শিশু ও সানিউরকে ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর আদালতে হাজির করতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ অনুসারে ২১ নভেম্বর পুলিশ জানায়, শিশুটিকে নিয়ে ১৬ নভেম্বর সকালে তার বাবা দেশত্যাগ করেছেন।

২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর হাইকোর্ট সানিউরের বাংলাদেশি পাসপোর্টের কার্যকারিতা সাময়িকভাবে স্থগিত করেন। একই সঙ্গে শিশুটি নিখোঁজ হয়েছে বলে থানায় সাধারণ ডায়েরি করতেও বলা হয়। এ ছাড়া আদালতের আদেশ সত্ত্বেও শিশুকে নিয়ে দেশ ত্যাগ করায় সানিউরের প্রতি আদালত অবমাননার রুল দেওয়া হয়।

এরপর ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর হাইকোর্ট আদেশে দেন। আদালতের আদেশ না মেনে তিন বছর বয়সী শিশুসন্তানকে নিয়ে দেশত্যাগ করা সানিউরকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করেন হাইকোর্ট। জরিমানার অর্থ পরিশোধ না করলে সানিউরকে আরও এক মাস কারাভোগ করতে হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়।

শিশুটির মায়ের আইনজীবী কাজী মারুফুল আলম আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, মানবাধিকার সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের তত্ত্বাবধানে এখন শিশুটি ও তার মা সাদিকা বনানীর একটি বাসায় আছেন।