‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ১২ নভেম্বর।
‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ১২ নভেম্বর।

প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে ফুসফুস ক্যানসারে জয়ী হওয়ার হার ৬৫ শতাংশের বেশি

নভেম্বর ফুসফুস ক্যানসার নিয়ে সচেতনতার মাস। এ উপলক্ষে এসকেএফ অনকোলজি আয়োজন করে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠান। সেখানে ফুসফুস ক্যানসার কেন হয়, কীভাবে নির্ণয় করতে হয়, বাংলাদেশে এর চিকিৎসাব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়। অনুষ্ঠানে অতিথি-আলোচক হিসেবে ছিলেন স্কয়ার হসপিটালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন। গত মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি এবং এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে ফুসফুস ক্যানসার নিয়ে বাংলাদেশের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন উপস্থাপক নাসিহা তাহসিন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে পাঁচ হাজার মানুষ মারা যান। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে এর বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার হার ৬৫ শতাংশের বেশি।

এরপর উপস্থাপক অতিথির কাছে জানতে চান ফুসফুস ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে। উত্তরে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, সারা পৃথিবীর মরণঘাতী ক্যানসারগুলোর মধ্যে ফুসফুস ক্যানসার একটি। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীতে ২২ লাখ মানুষ এ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন, যার মধ্যে ১৭ লাখ মারা গেছেন।

ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি কাদের বেশি? এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘ঝুঁকি কাদের বেশি, এটা জানার আগে জানতে হবে, এটি কেন হয়। আমরা জানি, ফুসফুস ক্যানসার ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রে ধূমপানের এবং বাকি ১৫ ভাগ অন্যান্য কারণে হয়। তাহলে যাঁরা ধূমপান করেন, যাঁর সামনে ধূমপান করা হচ্ছে, ব্রেকিং শিপ ইন্ডাস্ট্রিজের থাকা অ্যাসবাস্টাসের সংস্পর্শে থাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা, বায়ুদূষণ যেখানে হয় সেখানকার বাসিন্দারা, গ্রামাঞ্চলে লাকড়ির চুলার পাশে সব সময় যাঁরা থাকেন এবং যক্ষ্মা রোগীরাই ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।’

বাংলাদেশে ফুসফুস ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, রোগনির্ণয়, ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসাসুবিধা বিষয়ে পরামর্শ দেন অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন।

ফুসফুস ক্যানসারের লক্ষণ সম্পর্কে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন কাশি, কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া, শরীরের ওজন কমে যাওয়া, বুকে ব্যথা করা ইত্যাদি। তাই এ ধরনের সমস্যা দেখা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

এ পর্যায়ে উপস্থাপক জানতে চান, কেন ফুসফুস ক্যানসার নারীদের চেয়ে পুরুষদের বেশি হয়? উত্তরে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘মোটাদাগে যদি বলতে হয়, তাহলে বলব, পুরুষের তুলনায় ধূমপান কম করেন বলেই নারীরা কম আক্রান্ত হন।’

ফুসফুস ক্যানসারের স্ক্রিনিং প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির গাইডলাইন অনুসারে, এ ক্ষেত্রে এলডিসিটি বা লোডো সিটিস্ক্যান করতে হয়। তাহলে এ স্ক্যান কারা করবেন? প্রতিদিন ২০টার মতো সিগারেট খাওয়া ৫০ বছরের ঊর্ধ্বদের প্রতিবছর একবার এ স্ক্রিনিং করতে হবে। যাঁরা ১৫ বছরের বেশি সময় সিগারেট খেয়েছেন বা সিগারেট ছাড়ার ১৫ বছর হয়নি, তাঁরাও প্রতিবছর একবার এ স্ক্রিনিং করবেন। যদি কেউ না পারেন, তাহলে বুকের এক্স-রেও করতে পারেন।’

ফুসফুস ক্যানসারের রোগীর ডায়াগনোসিস করতে কী কী করণীয়, এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘মানুষের শরীরে কোটি কোটি কোষ রয়েছে। কোষগুলোর ভেতরে থাকে নিউক্লিয়াস। এতে আবার ডিএনএ ও জিন থাকে। যখন ক্যানসারের অনুঘটকের কারণে ডিএনএ ও জিনের মিউটেশন বা পরিবর্তন হয়, তখন এটাকে ফুসফুস ক্যানসার বলা হয়। এর জন্য উপযোগী ডায়াগনোসিস করতে হলে আগে কোর-বায়োপসি বা লিকুইড বায়োপসি করতে পারি। এ ছাড়া টিউমার ডিএনএ এবং পজিট্রন এমিশন টমোগ্রাফি (পিইটি) করতে পারি, যার মাধ্যমে জানতে পারি—ক্যানসারটা শরীরে কত দূর ছড়িয়েছে।’

তারপর উপস্থাপক অতিথির কাছে জানতে চান, ফুসফুস ক্যানসারের ধাপ কী কী এবং এ ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসাপদ্ধতি কিসের ওপর নির্ভর করে? অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘স্টেজিং বা ধাপের ওপরই চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়। এর ভিত্তিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি—রোগীকে সার্জারি করব কি করব না। ধাপগুলো হলো স্টেজ ওয়ান, স্টেজ টু, স্টেজ থ্রি-এ, স্টেজ থ্রি-বি ও স্টেজ ফোর। সুতরাং স্টেজ নির্ধারণের পরই চিকিৎসা শুরু করতে হবে।’

ফুসফুসে ক্যানসারের ধরন সম্পর্কে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, এটা তিন ধরনের হয়। প্রথমটি, অ–ক্ষুদ্র কোষের ফুসফুস ক্যানসার। এটি স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা, অ্যাডেনোকার্সিনোমা বা বড় সেল কার্সিনোমা হতে পারে। দ্বিতীয়টি, ছোট কোষের ফুসফুস ক্যানসার। এটি খুব সাধারণ ধরনের নয়, তবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তৃতীয়টি, ফুসফুসের কার্সিনয়েড টিউমার। এটি একটি বিরল ধরনের ফুসফুস ক্যানসার, যা নিউরোএন্ডোক্রাইন কোষকে প্রভাবিত করে।

ফুসফুস ক্যানসারের চিকিৎসাপদ্ধতি প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ফুসফুস ক্যানসারের চিকিৎসাপদ্ধতি হচ্ছে সার্জারি। এ সার্জারির রয়েছে বিভিন্ন ভাগ, যা টিউমারের ধরনের ওপর নির্ভর করে। সেগুলো হলো রোবোটিক লোবেক্টমি, নিউমোনেক্টমি, সেগমেন্টাল রিসেকশন, ওয়েজ রিসেকশন। সার্জারি ছাড়াও রয়েছে বিকিরণ থেরাপি, কেমোথেরাপি, রেডিও সার্জারি, টার্গেটেড ড্রাগ থেরাপি, জৈবিক থেরাপি বা ক্যানসার প্রতিরোধক টিকা ও ওষুধ। এ ধরনের সব চিকিৎসাই বাংলাদেশে রয়েছে। তাই ফুসফুস ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য কারও বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।