মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, গান, নৃত্য আর কথামালার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামে উদ্যাপিত হচ্ছে মহান বিজয় দিবস। দিবসটি উপলক্ষে আজ শনিবার ভোর থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মিউনিসিপ্যাল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠের অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সর্বস্তরের মানুষ।
সূর্যোদয়ের পর শহীদ মিনারে প্রথমে নগর পুলিশের একটি চৌকস দলের সশস্ত্র অভিবাদনের মধ্য দিয়ে বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। পাশাপাশি সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সামনে শেখ রাসেল চত্বরে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বিজয়ের বার্তা দেওয়া হয়।
বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মোহাম্মদ সালাউদ্দিন তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসেন। তাঁদের বাসা নগরের এনায়েত বাজার এলাকায়। দুই মেয়ের হাতেই ছিল জাতীয় পতাকা। সালাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামের এ ভূখণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিমিময়ে এই অর্জন। দুই মেয়েকে সে ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিতেই এসেছি।’
সকালে শুরুতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী এবং কাউন্সিলররা শহীদ মিনারে ফুল দেন। এরপর একে একে বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়, জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নুরে আলম মিনা, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ ছাড়া ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম জেলা ও নগর ইউনিট কমান্ড।
সকাল থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ফুল নিয়ে আসতে থাকেন। এ সময় তাঁদের হাতে বিভিন্ন ধরনের স্লোগানসংবলিত প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। সকালে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের নেতৃত্বে দলের পক্ষ থেকে অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে নগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে মহান বিজয় দিবসের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক ও নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন সাংবাদিকদের বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে লাখো মানুষ জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করা হয়। এখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য দেশবিরোধীরা এখনো দেশের মানুষকে পেছনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের রুখে দিতে হবে।
বেলা ১১টার দিকে নগরের এনায়েত বাজার মোড়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে বিজয় শোভাযাত্রা করে নগর বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। শোভাযাত্রাটি শেষ হয় অস্থায়ী শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে গিয়ে। পরে নেতা-কর্মীরা ফুল দিয়ে বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, নগর বিএনপির আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম।
পরে আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, একাত্তরে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু ৫২ বছর পার হলেও দেশের মানুষের দুর্দশা দূর হয়নি। মানবাধিকার ও ভোটাধিকার এখনো অধরা। অন্যদিকে আগামী ৭ জানুয়ারি বানরের পিঠা ভাগাভাগির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এমন নির্বাচন দেশের মানুষ দেখতে চান না। দেশের মানুষ ভোটাধিকার ফেরত চান। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানান তিনি।
আরও যারা শ্রদ্ধা জানাল
অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) চট্টগ্রাম জেলা কমিটি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি, জাসদ, বাসদ, ন্যাপ, চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন।
অন্যদিকে সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যে বোধন, প্রমা, খেলাঘর, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, উচ্চারক, চারণ, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদসহ বিভিন্ন সংগঠন শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানায়।
বিজয় দিবস উপলক্ষে সকাল আটটায় এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরে বাংলাদেশ পুলিশ, আনসার-ভিডিপি, বিএনসিসি, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, কারারক্ষী, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা-সামাজিক প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ স্কাউট, রোভার স্কাউট, গার্লস গাইডের অংশগ্রহণে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শারীরিক কসরত প্রদর্শনীতে অংশ নেয়।
বেলা সাড়ে ১১টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনার আয়োজন করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর শোষণ-নিপীড়ন চালাতে থাকে।
শোষণ-বঞ্চনা সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে জবাব দেন এ ভূখণ্ডের মানুষ। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযোদ্ধারা। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয় ছিনিয়ে আনেন। বীর শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে হবে।