ছেলের সঙ্গে রিমন ইসলাম
ছেলের সঙ্গে রিমন ইসলাম

দেশে ফিরে এভাবে ঈদ করতে চাননি রিমন

দুবাই প্রবাসী মো. রিমন ইসলাম চেয়েছিলেন এবার দেশে ফিরে স্ত্রী ও প্রথম সন্তানের সঙ্গে ঈদ করবেন। সেই রিমন দেশে ফিরেছেন স্ত্রীর লাশ দাফনের জন্য। ১১ জুন সকালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম দেন তাঁর স্ত্রী মাহবুবা নাজমিন; আর রাতেই বিভিন্ন জটিলতায় তিনি মারা যান। তাই রিমনকে ঈদ করতে হবে শুধু নবজাতক ছেলের সঙ্গে।

আজ রোববার মুঠো কথা হয় রিমনের সঙ্গে। আক্ষেপ করে বললেন, এভাবে ঈদ করতে হবে তা কখনো ভাবেননি। অস্ত্রোপচারে ছেলের জন্মের পর স্ত্রীকে বলেছিলেন ছেলেকে কাছে নিতে, তখন দুবাই থেকে ভিডিও কলে মা ও ছেলেকে একসঙ্গে দেখেছিলেন। সেটাই তিনজনের একসঙ্গে শেষ দেখা। তারপর তো সব ওলটপালট হয়ে গেছে।

স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে রিমন দেশে ফিরেছেন ১২ জুন সন্ধ্যায়। দেশে ফিরে স্ত্রীর দাফনসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতায় কেটেছে। ছেলে হলে মাহবুবা নাম রাখতে চেয়েছিলেন রিহান। রিমন ছেলের মায়ের ইচ্ছে অনুযায়ী ছেলের নাম রেখেছেন রিহান। বর্তমানে দেখভাল করছেন রিমনের বোন। তাঁর নিজের দুই সন্তান আছে।
রিমন বললেন, ‘ছেলেকে নিজের বোনের কাছে দিয়েছি। বোন তাঁর দুই সন্তানের মতো আমার ছেলেকেও দেখছেন। তাই কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছি। বোনের স্বামীও আমার ছেলেকে অনেক আদর করেন।’

অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্ম দেওয়ার পর মাহবুবা নাজমিন তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, পুত্রসন্তানের মা হলাম।’ আর রাতেই তিনি মারা যান। রিমন বলেন, ‘সিজারে (অস্ত্রোপচারে) ছেলের জন্মের আধঘণ্টার মধ্যে আমার স্ত্রীর চেতনা ফিরে আসে। আমার সঙ্গে কথা বলে। আমার বাবা, মা, ওর পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গেও কথা বলে। সব ঠিকঠাক ছিল। আমার সঙ্গে যখন শেষ কথা হয়, তখন বলেছিল, এখন তো আর চিন্তার কিছু নেই, তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। আমি দুই ঘণ্টাও ঘুমাতে পারিনি, জেগে দেখি ফোন, তারপর শুনলাম স্ত্রী মারা গেছে। আমি এখনো এ কথা বিশ্বাসই করতে পারছি না।’

রিমন জানান, তিনি দুবাইয়ে যান গত বছরের অক্টোবরে। দুবাই বসে তিনি বাবা হতে চলেছেন সে খবর পেয়েছিলেন। তখন থেকেই স্বপ্ন বুনছিলেন দেশে ফিরে স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে ঈদ করবেন।

বিয়ের এক বছর পাঁচ মাসের মাথায় মাহবুবা নাজমিন মারা গেলেন। রিমন ও মাহবুবা দুজনের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনায়। রিমন বিদেশ যাওয়ার পর ২০ বছর বয়সী মাহবুবা নাজমিন বাবার বাড়িতেই বেশির ভাগ সময় থাকতেন। তাঁর সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ ছিল ১৯ জুন। ১০ জুন প্রসবব্যথা উঠলে পরিবারের সদস্যরা প্রথমে চন্দ্রঘোনা ও নোয়াপাড়ায় দুটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। তবে জটিলতা দেখে সেসব হাসপাতালে ভর্তি করতে না চাইলে তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাজমিনকে ভর্তি করা হয়।

রিমনের দেশে ফেরার কথা ছিল গত ২৫ মে। তবে জটিলতায় তখন দেশে ফিরতে পারেননি। বারবার আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। চিকিৎসক নাকি পরিবারের সদস্যদের—কার গাফিলতি ছিল। কেউ কিছু বুঝতেও পারছেন না।’

পরিবারের সদস্যরা রিমনকে জানান অস্ত্রোপচারের পর মাহবুবা নাজমিন ভালো ছিলেন। তারপর জ্বর আসে। দ্রুত আইসিইউতে নেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পরই চিকিৎসকেরা জানান, মাহবুবা মারা গেছেন। অস্ত্রোপচারের আগে মাহবুবা নাজমিনকে দুই ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছিল। তখন রিমন নিজে ফোন করে কাপ্তাইয়ের দুজন ডোনারকে (রক্তদাতা) হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন। তবে অস্ত্রোপচারের পর আরও এক ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছিল, তা কোথা থেকে দেওয়া হয়েছিল তা রিমন এখনো জানতে পারেননি।

অস্ত্রোপচারের সময় যে চিকিৎসক ছিলেন, বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে তাঁর সঙ্গে এখনো কথা বলতে পারেননি রিমন। তাই আসলে কোন ধরনের জটিলতা হয়েছিল সে বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না।

একই এলাকায় বাড়ি ছিল রিমন ও মাহবুবার। দুজনের প্রেম ও বিয়ে মিলে প্রায় ৯ বছরের জানাশোনা। রিমন তাঁর ফেসবুকে স্ত্রীর সঙ্গে ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন, তিনি তাঁর সবটা দিয়ে স্ত্রীকে আগলে রাখবেন। তবে আগলে রাখতে পারেননি। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ফেসবুকেই সেই আক্ষেপ প্রকাশ করছেন রিমন।

রিমন জানান, তিনি আর দুবাই ফিরবেন না। তিনি বলেন, ‘ছেলেটা জন্মের পরই মাকে হারাল। মায়ের আদর পেল না। আমি চলে গেলে ও বাবার আদরও পাবে না। তাই দেশেই থেকে যাব। আমার বাবার একটা মুদিদোকান আছে। তা থেকে যে আয় হবে, তা দিয়ে সংসার চলে যাবে।’