পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। গতকাল রোববার পর্যন্ত ৭২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। অথচ গত বছরের প্রথম ছয় মাসে এ তিন জেলায় কোনো ডেঙ্গু রোগী ছিল না। ম্যালেরিয়াপ্রবণ পার্বত্য এলাকায় ডেঙ্গুর বিস্তার এ অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে।
এদিকে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে আগের বছরের এই সময়ের তুলনায় ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। যদিও আরেক পার্বত্য জেলা বান্দরবানে আগের বছরের তুলনায় তা কমেছে।
ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু—দুটিই মশাবাহিত রোগ। ম্যালেরিয়া হয় অ্যানোফিলিস জাতীয় স্ত্রী মশার কামড়ে আর ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা।
তিন পার্বত্য জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশে মোট ম্যালেরিয়া রোগীর ৯০ শতাংশের বেশি আক্রান্ত হন পার্বত্য তিন জেলায়। রাঙামাটিতে গত বছরের প্রথম ছয় মাসে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন ৯০০ জন। চলতি বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৩২ জনে।
‘এবার প্রথম ছয় মাসে জেলায় ম্যালেরিয়া রোগী বেড়ে গেছে। এর মধ্যে আবার যুক্ত হয়েছে ডেঙ্গু। এটা নিঃসন্দেহে একটা চিন্তার বিষয়।’বিনোদ শেখর চাকমা, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা
খাগড়াছড়িতে গত বছরের ছয় মাসে ম্যালেরিয়া রোগী ছিলেন ৭৪ জন। এবার এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে ১২২ জন। তবে বান্দরবানে গত বছরের প্রথম ছয় মাসে ৫ হাজার ৬৯২ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এবার তা কমেছে ২ হাজার ৯৩৩ জন। এ বছর তিন জেলার মধ্যে বান্দরবানে তিনজন এ পর্যন্ত ম্যালেরিয়ায় মারা গেছেন। গত বছর এ সময় সাতজনের মৃত্যু হয়েছিল।
রাঙামাটি সদর হাসপাতালে গতকাল তিনজন ম্যালেরিয়া রোগী ছিলেন। তবে তাঁরা সেরে উঠছেন বলে জানান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বিনোদ শেখর চাকমা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার প্রথম ছয় মাসে জেলায় ম্যালেরিয়া রোগী বেড়ে গেছে। এর মধ্যে আবার যুক্ত হয়েছে ডেঙ্গু। এটা নিঃসন্দেহে একটা চিন্তার বিষয়।’
রাঙামাটির চারটি উপজেলা বেশি ম্যালেরিয়াপ্রবণ। সেগুলো হলো জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, বাঘাইছড়ি ও রাজস্থলী। এর মধ্যে জুরাছড়িতেই জেলায় মোট ম্যালেরিয়া আক্রান্তের ৫১ শতাংশ। জুরাছড়ির দুমদুমিয়া ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত।
রাঙামাটির সিভিল সার্জন নীহার রঞ্জন নন্দী প্রথম আলোকে বলেন, এলাকাটি ভারতের সীমান্তসংলগ্ন ও অত্যন্ত দুর্গম। স্বাস্থ্যকর্মীদের সেখানে যেতে বেশ বেগ পেতে হয়। পাহাড়ে ম্যালেরিয়া রোধের বড় প্রতিবন্ধকতা দুর্গমতা।
এ অবস্থা পার্বত্য এলাকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেছে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতা বেশি জরুরি। পাহাড়েও এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।মুশতাক হোসেন, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা
গত বছরের প্রথম ছয় মাসে তিন পার্বত্য জেলায় কোনো ডেঙ্গু রোগী ছিল না। তবে এ বছর গতকাল পর্যন্ত রাঙামাটিতে ১৫, খাগড়াছড়িতে ৪৭ ও বান্দরবানে ১০ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে জুলাইয়ের আট দিনেই ভর্তি হন ৪৫ জন।
খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ক্যাচিং হ্লা মারমা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এবার ম্যালেরিয়ার সঙ্গে ডেঙ্গু রোগী বেড়ে গেছে। ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে দুজন স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত হয়েছেন। তবে আক্রান্ত রোগীর বেশির ভাগেরই ঢাকা বা চট্টগ্রামে ভ্রমণের ইতিহাস আছে।
পার্বত্য জেলাগুলোর সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামে চলাচলকারী বাসগুলোতেই এডিস মশা পাহাড়ে আসে বলে মন্তব্য করেন রাঙামাটির সিভিল সার্জন নীহার রঞ্জন নন্দী। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসগুলোতে প্রচুর মশা। এগুলো মারতে তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না। আর আমরা দেখেছি এখানে ডেঙ্গুর যেসব রোগী আছেন, তাঁদের বেশির ভাগ সদর উপজেলার বাসিন্দা।’
এবার ম্যালেরিয়ার সঙ্গে ডেঙ্গু রোগী বেড়ে গেছে। ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে দুজন স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত হয়েছেন। তবে আক্রান্ত রোগীর বেশির ভাগেরই ঢাকা বা চট্টগ্রামে ভ্রমণের ইতিহাস আছে।খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ক্যাচিং হ্লা মারমা
খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা বাসগুলোতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে গাফিলতির বিষয়টি স্বীকার করেন। খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায় দাশ প্রথম আলোকে বলেন, আগে অব্যবস্থাপনা ছিল। কিন্তু এখন বাস ছাড়ার আধা ঘণ্টা আগে তাতে মশানাশক ব্যবহার করাটা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ জন্য মানোন্নয়ন কমিটিও করা হয়েছে।
পাহাড়ে এ বছর ম্যালেরিয়ার পাশাপাশি ডেঙ্গুর বিস্তারের পেছনে আবহাওয়া একটা বড় কারণ বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ অবস্থা পার্বত্য এলাকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেছে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতা বেশি জরুরি। পাহাড়েও এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।