খাদ্য জীবন বাঁচায়। আবার অনিরাপদ খাদ্য মানুষের রোগব্যাধি ও মৃত্যুর কারণ হতে পারে। নানাভাবে খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর উপকরণ ব্যবহৃত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার বিক্রি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ এ খাবার গ্রহণ করে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। মানুষের সুস্থ জীবনের জন্য নিরাপদ খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, খাদ্যনিরাপত্তার চারটি ‘পিলার’ বা স্তম্ভ আছে। এগুলো হলো সহজলভ্যতা, প্রবেশাধিকার, উপযোগিতা ও স্থিতিশীলতা। বাংলাদেশে শুধু নয়, সারা বিশ্বে নিরাপদ খাদ্য ভোক্তার অধিকার হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে সংবিধান অনুযায়ী মানুষের জীবনধারণের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার অন্যতম হলো খাদ্য। বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা সাংবিধানিকভাবে মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত না হলেও রাষ্ট্র পরিচালনার একটি মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃত। জনস্বাস্থ্য ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধানে ব্রিটিশ আমল থেকে অনেক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ২৭২ ধারা অনুযায়ী বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে দূষিত খাবার ও পানীয় বিক্রি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪–এর ধারা ২৫(গ) অনুসারে খাদ্যে ভেজালকে মৃত্যুদণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনিরাপদ খাদ্য বা ভেজাল খাদ্যের বিষয়টি ‘ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্যক্রম’ হিসেবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯–এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ আইনে খাদ্যপণ্যে ভেজাল মিশ্রণ একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে কারাদণ্ড ও জরিমানা আরোপের বিধান করা হয়েছে। জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে বিশেষ আইন প্রণীত হয়েছে ২০১৩ সালে। নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩–এর ২ ধারা অনুযায়ী ‘নিরাপদ খাদ্য’ বলতে প্রত্যাশিত ব্যবহার ও উপযোগিতা অনুযায়ী মানুষের জন্য বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত আহার্য বোঝানো হয়েছে। এ ছাড়া বিএসটিআই আইন ২০১৮ এবং আয়োডিনযুক্ত লবণ আইন ২০২১ নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধানে আইনি কাঠামোর অংশ।
নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩-তে নিরাপদ খাদ্যব্যবস্থা–সম্পর্কিত বিভিন্ন বিধিনিষেধের উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিষাক্ত দ্রব্যের ব্যবহার পরিহার; তেজস্ক্রিয়, ভারী ধাতু ইত্যাদির মাত্রাতারিক্ত ব্যবহার রোধ; ভেজাল খাদ্য বা খাদ্যোপকরণ উৎপাদন, আমদানি, বিপণন ইত্যাদি পরিহার; নিম্নমানের খাদ্য উৎপাদন না করা; খাদ্য সংযোজন দ্রব্য বা প্রক্রিয়াকরণ–সহায়ক দ্রব্যের ব্যবহার না করা; শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত তেল, বর্জ্য, ভেজাল বা দূষণকারী দ্রব্য ইত্যাদি খাদ্য স্থাপনায় না রাখা; মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ না রাখা; বৃদ্ধি প্রবর্ধক, কীটনাশক, বালাইনাশক বা ওষুধের অবশিষ্টাংশ, অণুজীব, ইত্যাদির ব্যবহার পরিহার; বংশগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনকৃত খাদ্য, জৈব খাদ্য, ব্যবহারিক খাদ্য, স্বত্বাধিকারী খাদ্য ইত্যাদি সরবরাহ বা বিক্রয় না করা; খাদ্য মোড়কীকরণ ও লেবেলিং পরিবর্তন না করা; মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত প্রক্রিয়ায় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, বিক্রয় ইত্যাদি পরিহার; রোগাক্রান্ত বা পচা মৎস্য, মাংস, দুগ্ধ বিক্রয় না করা; হোটেল রেস্তোরাঁ বা ভোজনস্থলের পরিবেশনসেবা দ্বারা ভোক্তার স্বাস্থ্যহানি না ঘটানো; ছোঁয়াচে ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তির দ্বারা খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত না করা; নকল খাদ্য উৎপাদন, বিক্রয় ইত্যাদি পরিহার; অনিবন্ধিত অবস্থায় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, বিক্রয় না করা; কর্তৃপক্ষ বা তদকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সহযোগিতা করা প্রভৃতি।
তা ছাড়া এ আইনে উপরিউক্ত যেকোনো দায়িত্বের লঙ্ঘন আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ আইনের অধীন একটি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বা তদকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করা যাবে। নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩–এর ধারা ৬৪ অনুযায়ী ‘বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ধারা ৬৫ অনুযায়ী সেই আদালতের বিচারক হবেন একজন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট। এই আদালতে খাদ্যসংক্রান্ত সব অপরাধের বিচার হবে। এটি খাদ্যসংক্রান্ত সব অপরাধের বিচারের জন্য মূল এবং নিয়মিত বিচারিক আদালত। ধারা ৬৬(২) অনুযায়ী নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বা তদকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা বা পরিদর্শক অভিযোগ পেলে অভ্যন্তরীণ তদন্ত ও অনুসন্ধান শেষে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে মামলা করবেন। এটি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মূল আইনি দায়িত্ব। এ ছাড়া ধারা ৬৬(৩) অনুযায়ী যেকোনো সাধারণ নাগরিক নিজেও অভিযোগের কারণ উদ্ভবের ৩০ দিনের মধ্যে সরাসরি বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে মামলা করতে পারেন। নিরাপদ খাদ্য আইনে ‘সামারি ট্রায়াল’ বা দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ আইনের আওতায় নিরাপদ খাদ্য আদালত ন্যূনতম ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ন্যূনতম ১ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড আরোপ করার ক্ষমতা রাখেন। অপরাধের পুনরাবৃত্তিতে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। ৬২ ধারা অনুসারে আদায় করা অর্থদণ্ডের ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রাপ্য হবেন। এ আইনের ৭৬ ধারায় দেওয়ানি প্রতিকারের সুযোগও রাখা হয়েছে।
মামলার কারণ উদ্ভবের ৩০ দিনের মধ্যে মামলা করার সময়সীমার বিধান এ আইনের একটি অন্যতম সীমাবদ্ধতা। ভেজাল খাদ্যের ক্ষতিকর দিক বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিলম্বে দেখা দিতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে, যা এ আইনে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ধারা ৭৩(৩) অনুযায়ী, ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যদ্রব্যের নমুনা যাচাই পরীক্ষার ব্যয় বহনের বাধ্যবাধকতা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ওপর আরোপ করা হয়েছে। ফলে অনেক সময় ভোক্তার আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় তাঁরা অভিযোগ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে কর্মরত বিচারকেরা তাঁদের নিয়মিত বিচারিক দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ফলে মামলার জট ও দীর্ঘসূত্রতা নিরাপদ খাদ্য আইনের কার্যকারিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩–এর ৭৫ ধারা অনুযায়ী, এ আইনের আওতায় করা অপরাধের বিচারের জন্য মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯–এর অধীন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার বিধান রাখা হয়েছে, যাতে জরুরি কোনো পরিস্থিতি দ্রুততার সঙ্গে সামলানো যায়। এটি স্পষ্ট যে এই ভ্রাম্যমাণ আদালত–ব্যবস্থা সাময়িক, অস্থায়ী, সীমিত এখতিয়ারসম্পন্ন এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য। আইনে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে কারাদণ্ড প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি, কিন্তু ‘প্রশাসনিক জরিমানা’ আরোপের ক্ষমতা দিয়েছে, যার সীমা অনধিক তিন লাখ টাকা পর্যন্ত (ধারা ৭৮)। কেউ জরিমানা পরিশোধ না করলেও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ নিজেরা সে জন্য কাউকে কারাদণ্ড আরোপ করতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে সরকারি দাবি আদায় আইন ১৯১৩ অনুসারে সরকারি দাবি গণ্যে সেটি আদায়যোগ্য হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এ আইনের আওতায় বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে মামলা করার পরিবর্তে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ শুধু প্রশাসনিক জরিমানা আদায়কে গুরুত্ব দিচ্ছে।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতি ব্যতীত নিজেরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারেন না। অন্যদিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানা করার এখতিয়ার থাকলেও শাস্তি হিসেবে কারাদণ্ড প্রদানের ক্ষমতা মোবাইল কোর্ট আইন অনুযায়ী সীমিত। শাস্তির ক্ষেত্রে তাই কারাদণ্ড প্রয়োগের দৃষ্টান্ত বিরল। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত তাৎক্ষণিকভাবে জরিমানা আরোপ করে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে নিঃসন্দেহে দ্রুত ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কিন্তু উপরিউক্ত অপরাধগুলো উৎপাটন, প্রতিরোধ এবং অপরাধীদের শাস্তি বিধানে তা সামগ্রিক অর্থে কার্যকর, স্থায়ী ও ফলপ্রসূ নয়। পত্রিকা, টিভি, নিউজ পোর্টাল কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমের প্রচার এটিকে দ্রুত, জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় বিচারপদ্ধতির রূপ দিয়েছে। সাধারণ মানুষের এ ধারণা জন্মেছে যে খাদ্যসংক্রান্ত অপরাধগুলোর বিচারের ক্ষমতা শুধু ভ্রাম্যমাণ আদালত ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের, যা আদতে সঠিক নয়। ফলে মূল বিচারিক আদালত তথা বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতের এখতিয়ার ও ক্ষমতা সম্বন্ধে মানুষ জানতে পারছে না।
এসব অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা থেকে সাধারণ জনগণ এ ধারণা লাভ করেন যে জরিমানাই হচ্ছে এসব অপরাধের একমাত্র শাস্তি। মূল আইনকে অকার্যকর রেখে, নিয়মিত ও স্থায়ী বিচারিক আদালতকে পাশ কাটিয়ে শুধু প্রশাসনিক জরিমানা কিংবা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা প্রয়োগের এ প্রবণতা সাময়িক উপশম দিলেও তা নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে পারছে না। শুধু জরিমানা আরোপ করে এসব অসাধু ব্যবসায়ীকে নিবৃত্ত রাখা অসম্ভব। অসৎ উপায়ে, প্রতারণা করে অর্জিত কালোটাকা জরিমানা হিসেবে প্রদান করে এই ব্যবসায়ীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। নিয়মিত ও স্থায়ী বিচারিক আদালতের আইনানুযায়ী কঠোর ও দৃষ্টানমূলক শাস্তি কার্যকর না করায় নিরাপদ খাদ্যের বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে পড়েছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এ দায় এড়াতে পারে না। মনে রাখতে হবে, আইনের প্রয়োগহীনতাও আইনের লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য।
সাঈদ আহসান খালিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক