শুনানিতে আপিল বিভাগ

কখন গ্রেপ্তার, তথ্য দিতে আপত্তি থাকার কথা নয়

সুপ্রিম কোর্ট
 প্রথম আলো ফাইল ছবি

গ্রেপ্তার ও হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে দেওয়া নির্দেশনা পুনর্বিবেচনা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানিতে আপিল বিভাগ বলেছেন, গ্রেপ্তার নিয়ে সমাজে নানা কথা হয়। বুড়িগঙ্গা নদী থেকে কাউকে গ্রেপ্তার করা হলেও তাকে থানায় নিয়ে কখন গ্রেপ্তার করা হলো, তা উল্লেখ করা যায়। তারিখ, সময় ও গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির সইসহ নথি (ডকুমেন্ট) দুই পক্ষের জন্যই শ্রেয়। কখন গ্রেপ্তার করা হলো, এই তথ্য দিতে আপত্তি থাকার কথা নয়।

ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার (৫৪ ধারা) ও হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের ধারা (১৬৭ ধারা) প্রয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া গাইডলাইন (নির্দেশনা) পুনর্বিবেচনা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের (রিভিউ) ওপর আজ বৃহস্পতিবার এ শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ কয়েকটি যুক্তিতে রাষ্ট্রপক্ষের পুনর্বিবেচনার আবেদন গ্রহণ করে আপিল করার অনুমতি দেন।

আপিল বিভাগের আদেশের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আপিল বিভাগ লিভ (আপিল করার অনুমতি) দিয়েছেন, এখন আপিলের ওপর শুনানি হবে।

অন্যদিকে রিট আবেদনকারীপক্ষের আইনজীবী অনীক আর হক প্রথম আলোকে বলেন, আপিল বিভাগের রায়ের নির্দেশনায় স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়নি। কাউকে বিনা পরোয়ানায় আটক, গ্রেপ্তার ও গ্রেপ্তার-পরবর্তী প্রক্রিয়ায় রায়ের নির্দেশনাগুলো পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের মেনে চলতে হবে।

২০১৬ সালের ২৪ মে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য ১০ দফা এবং অভিযোগ আমলে নেওয়ার বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেট, বিচারক ও ট্রাইব্যুনালের প্রতি ৯ দফা গাইডলাইন দেওয়া হয়। এ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ২০১৭ সালে আবেদন করে। এই পুনর্বিবেচনার আবেদনের ওপর আজ শুনানি হয়।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন শুনানি করেন, সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার। অন্যদিকে রিট আবেদনকারীপক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও অনীক আর হক।

গ্রেপ্তার ব্যক্তির সই নেওয়ার বিষয়টি আইনে নেই

শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পর তাৎ​ক্ষণিক একটি মেমোরেন্ডাম (স্মারক) তৈরি করা এবং গ্রেপ্তার ব্যক্তির সই নেওয়ার বিষয়টি নির্দেশনায় রয়েছে। নির্দেশনায় তাৎক্ষণিক শব্দের ব্যাখ্যা নেই। আইনে আছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে। পরিস্থিতি সাপেক্ষে মেমোরেন্ডাম প্রস্তুত করতেও সময় লাগবে।

এ সময় আদালত বলেন, ২৪ ঘণ্টার বেশি হলে ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ আছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তির সই নেওয়া হলে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। এখানে মেমোরেন্ডাম (স্মারক) স্বচ্ছতার জন্য। গ্রেপ্তার করা ব্যক্তির যদি সই নেওয়া হয়, তাহলে আগে গ্রেপ্তার করে পরে দেখানোর সুযোগ থাকবে না।

পরে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, পুলিশ যখন দায়িত্ব পালন করতে থানার বাইরে যায়, তখন সাধারণ ডায়েরি করেই বের হয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তির সই নেওয়ার কথা আইনের কোথাও নেই। মেমোরেন্ডাম তৈরি করতে হবে, এটিও আইনে নেই। ১২ ঘণ্টার মধ্যে আত্মীয়স্বজনকে জানাতে হবে, তা-ও আইনে নেই।

শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বাংলা ভাইকে যখন ধরা হয়, তখন গোলাগুলি হচ্ছিল। হোলি আর্টিজান হামলার মতো ঘটনার ক্ষেত্রে এটি (সই নেওয়া) কীভাবে সম্ভব? পরিস্থিতির সঙ্গে ভারসাম্য করতে হবে। গুরুতর অপরাধী, জঙ্গি ধরা হলে, তারা পরিচয়-ঠিকানা বলতে চায় না। সাক্ষী দিতে চায় না।

অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে আদালত বলেন, তাৎক্ষণিক শব্দের জন্য যদি প্রয়োগই (নির্দেশনা) না করেন, তাহলে কী হবে? প্রয়োগ করতে গেলে কোথায় কী সুবিধা ও অসুবিধা হচ্ছে, তা দেখা যাবে। প্রতিটি বিষয়কে যান্ত্রিকভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। ঠিকানা না দেওয়ায় যদি আত্মীয়স্বজনকে না জানানোর মতো পরিস্থিতি হয়, সে ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটকে জানানোর সুযোগ আছে। থাম (আঙুলের ছাপ) দিয়ে এখন পরিচয় শনাক্ত করা যায়।

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, দুর্ধর্ষ অপরাধী গ্রেপ্তার করতে হবে। একইভাবে মানুষের মৌলিক অধিকারও দেখতে হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে।

একপর্যায়ে আদালত বলেন, সাক্ষী সুরক্ষা আইন হচ্ছে না কেন? তখন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, করা উচিত, প্রক্রিয়াধীন।

রিট আবেদনকারীপক্ষের আইনজীবী অনীক আর হক বলেন, বিনা পরোয়ানায় ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের বিষয় নিয়ে মূলত মামলাটি। তাৎক্ষণিক বলতে যখনই সম্ভব হবে, তখনই মেমোরেন্ডাম (স্মারক) লিখতে হবে। পুলিশকে কেস ডায়েরি লিখতে হয়। এ ছাড়া পৃথিবীর সভ্য দেশে আটক বা গ্রেপ্তার ব্যক্তির স্বজনকে ফোন করে জানানো হয়।

ঘটনার পূর্বাপর

দুই যুগের বেশি সময় আগে ১৯৯৮ সালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজাকে (রুবেল) ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের পর ওই বছরের ২৩ জুলাই মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।

এ ঘটনায় গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টসহ (ব্লাস্ট) অন্যরা হাইকোর্টে রিট করে। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট এ বিষয়ে কয়েক দফা নির্দেশনাসহ রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের ওপর ২০১৬ সালের ২৪ মে আপিল বিভাগ রায় দেন।

রায়ে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য ১০ দফা এবং অভিযোগ আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট, বিচারক ও ট্রাইব্যুনালের প্রতি ৯ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদনটি (রিভিউ) করে, যার ওপর আজ আপিল বিভাগে শুনানি হয়।