কলকাতায় আমি যখন দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন সীমান্ত তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল এবং নাগা ও মিজোদের বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে ছিল। শুধু পশ্চিমবঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক ছিল না। নকশালপন্থীদের সৃষ্ট সহিংসতায় ১৯৭১-এর মার্চে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বানচালের আশঙ্কা দেখা দেয়। তাই আশঙ্কা করা হয় যে জনগণ তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না-ও আসতে পারেন। আমাকে বেসামরিক সরকারকে সহায়তা এবং প্রত্যেকে যাতে নির্ভয়ে ও পক্ষপাতহীনভাবে ভোট দিতে পারেন, তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গে আমরা প্রায় তিন ডিভিশন (৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার) সৈন্য নিয়ে আসি। শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হয়ে যায়। কিন্তু নকশালপন্থীদের সহিংসতা প্রতিরোধে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করতে আমরা সৈনিকদের রেখে দিই। পশ্চিমবঙ্গে সৈনিকদের মোতায়েন রাখলেও তাদের ভারী অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি অন্যত্র থেকে যায়।
কারণ, যে কাজে তাদের নিয়োজিত করা হয়, তাতে এগুলোর প্রয়োজন ছিল না। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতি বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছানোর সময় আমাদের সৈনিক ছিল বটে, তবে যুদ্ধ করতে তাদের যে ধরনের অস্ত্রের দরকার, তা ছিল না।
পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক সংঘর্ষ আমাদের অপ্রস্তুত করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে আমাদের পীড়াপীড়ি করে ভারতে প্রকাশ্য প্রতিবাদ ওঠে। বিরাটসংখ্যক শরণার্থীর আগমনে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। নিষ্ক্রিয় থাকার দরুন আমাদের সেনাবাহিনী সমালোচিত হয়। কিন্তু অল্পকাল পরই এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে পারে। সে কারণে পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ড এবং অভ্যন্তরীণ অবস্থার প্রতি আমাদের অধিকতর সতর্ক দৃষ্টি রাখার প্রয়োজন পড়ে।
পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটেছিল, সেসব তথ্য আসত সংবাদপত্র, শরণার্থী এবং আমাদের গোয়েন্দা সূত্র মারফত। এতে মনে হয়েছিল, পাকিস্তানিরা ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কয়েক দিনের মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রত্যাশা করছে। তারা বাঙালি, নিয়মিত সেনাবাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনীর সৈনিকদের বিদ্রোহ করার সম্ভাবনাটি বিবেচনায় আনেনি। নিয়মিত সেনাবাহিনীর প্রায় পাঁচ হাজার বাঙালি এবং পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশ বাহিনীতে আরও বেশিসংখ্যক সদস্য ছিলেন, যাঁদের অধিকাংশ দেশপ্রেমিক বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে বাঙালিরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রশংসনীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ওই সময় দেশের মধ্যে তাদের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার। বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা সবচেয়ে বড় যে ভুলটি করেছিলেন, তা হলো সুসজ্জিত পাকিস্তানিদের সঙ্গে গেরিলা অভিযানের পরিবর্তে প্রথাগত যুদ্ধের পথটি বেছে নিয়ে। পাকিস্তানিরা পশ্চিম অঞ্চল থেকে আকাশপথে আরও সৈন্য নিয়ে আসে এবং ১৯৭১-এর এপ্রিলের শেষ নাগাদ প্রতিরোধ দুর্বল করে ভেঙে ফেলে। মুক্তিবাহিনীর কোনো সংগঠিত ও সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা ছিল না। তাই বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকায় ছোট ছোট অভিযান পরিচালনা করতে হচ্ছিল।
১৯৭১-এর জুনে সামরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রাথমিক মূল্যায়নের প্রস্তুতিপর্বে আমার লক্ষ্য ছিল সৈন্যসংখ্যার প্রয়োজনীয়তা ও অভিযান পরিচালনা-সংক্রান্ত পরিকল্পনার বিস্তারিত রূপরেখা ব্যাখ্যা করা।
আমার অধীনে নিদেনপক্ষে আট ডিভিশন সৈন্য প্রত্যাশা করেছিলাম। তবে আমরা ছয় ডিভিশন ও তিনটি অতিরিক্ত ব্রিগেড, অর্থাৎ মোটামুটি সাত ডিভিশন সৈন্য সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এ ধরনের অভিযানের জন্য আমি ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার সৈন্য পেয়েছিলাম। এটা আমাকে পাকিস্তানিদের তুলনায় খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে রাখেনি।
চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল অবশ্যই ঢাকা। ভেবেছিলাম, নদী দিয়ে বিভক্ত এলাকা অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানকে এভাবে চারটি সেক্টরে বিভক্ত করলে আমাদের অভিযান পরিচালনা সহজতর হবে, যেমন—
(ক) উত্তর-পশ্চিম সেক্টর: প্রধান যোগাযোগকেন্দ্র হওয়ার দরুন আমাদের লক্ষ্য ছিল বগুড়া দখলের মাধ্যমে এই সেক্টরে অভিযানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে বেসামাল করে ফেলা। বগুড়া পৌঁছানোর সর্বোৎকৃষ্ট পথ হলো হিলি-ঘোড়াঘাট-পলাশবাড়ির ওপর দিয়ে অতিক্রান্ত অক্ষরেখা বরাবর অগ্রসর হওয়া এবং এভাবে উত্তরাঞ্চলে মোতায়েন পাকিস্তানি সেনাদের দেশের অবশিষ্টাংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। সুতরাং শত্রুসেনাদের দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও রংপুরে স্থির অবস্থায় রাখার সিদ্ধান্ত নিই, একই সঙ্গে ঘোড়াঘাট হয়ে বগুড়া প্রবেশের লক্ষ্যকে আমাদের মূল প্রয়াস হিসেবে নির্ধারণ করি।
(খ) দক্ষিণ-পশ্চিম সেক্টর: এ সেক্টরের প্রধান যোগাযোগস্থল যশোর, যা ঝিনাইদহ, মাগুরা ও ফরিদপুর হয়ে ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত। তাই ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার যোগাযোগকেন্দ্রগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ কেন্দ্রগুলো দখল করতে পারলে এ সেক্টরে সক্রিয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত করা যাবে। একবার যশোর, ঝিনাইদহ ও মাগুরা হস্তগত হলে অন্যান্য স্থানের ব্যাপারে পরে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।
(গ) পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টর: এ সেক্টরের দক্ষিণ-পূর্বে চাঁদপুর ও আশুগঞ্জে মেঘনা নদীর সম্মুখবর্তী বূহ্যগুলোর নিয়ন্ত্রণ অতি জরুরি। কারণ, এগুলো দখলে আনতে পারলে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। অধিকন্তু এটা ঢাকা দখলের অভিযান আরও সহজতর করবে। এ নদীপথের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রান্ত হলো চাঁদপুর, দাউদকান্দি ও আশুগঞ্জ নদীবন্দর। এ সেক্টরের উত্তরাংশে মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল মৌলভীবাজারের যোগাযোগকেন্দ্র শমশেরনগর বিমানঘাঁটি ও সিলেট শহর। এই শহরটিকে দেশের অবশিষ্ট এলাকা থেকে সহজেই বিচ্ছিন্ন করা যেতে পারে, যেহেতু এর যোগাযোগব্যবস্থা হয় নৌপথে, না হয় মৌলভীবাজার হয়ে।
(ঘ) ঢাকা: পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্র ঢাকা ছিল আমাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। একমাত্র উত্তর দিক দিয়ে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হতে কোনো বড় নৌ-প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হয় না। তবে এ প্রচেষ্টায় টাঙ্গাইল ও তারপর ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার আগে জামালপুর অথবা ময়মনসিংহ, উভয়ই ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিণে অবস্থিত, দখল করা জরুরি।
আমরা জানতাম যে হাতে সময় স্বল্প। যত শিগগির সম্ভব শত্রুকে বিনাশ করতে হবে। সম্ভাব্য সব দিক থেকে বহুমুখী আক্রমণের দ্বারাই শুধু তা সম্ভবপর। প্রতিটি পরিকল্পনা একটি পারস্পরিক সহযোগিতার ফল। উদ্ভূত আকস্মিক পরিস্থিতিতে এর পুনর্বিন্যাস পরীক্ষা, সংশোধন অথবা পরিবর্তন করা হয়।
আমাদের পরিকল্পনাও প্রাথমিকভাবে পূর্বাঞ্চলের কমান্ড সদর দপ্তরে আমার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান এবং আমার চিফ অব স্টাফ জেনারেল জ্যাকবের সহযোগিতায় প্রস্তুত করা হয়। আমার অধীন ঊর্ধ্বতন ফিল্ড অধিনায়ক লে. জেনারেল সগত সিং, লে. জেনারেল টি এন রায়না, লে. জেনারেল এম এল থাপান ও মে. জেনারেল গুরবক্স সিং, এ ব্যাপারে তাঁদের নিজেদের মতামত দিয়ে সহযোগিতা করেন। পরিকল্পনাটি সেনাসদরে উপস্থাপন করে তাঁদের অনুমোদন নেওয়া হয়।
১৯৭১-এর অক্টোবর নাগাদ পাকিস্তানিরা পূর্বাঞ্চলে তাদের স্বাভাবিক সৈন্যসংখ্যা চারটি ব্রিগেড-সংবলিত এক ডিভিশনের (২০-২৫ হাজার সৈনিক) স্থলে প্রায় ৮০ হাজারে উন্নীত করে। এর মধ্যে ৩৫টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন, ৬টি আর্টিলারি রেজিমেন্ট, কিছু পৃথক মর্টার ও ফিল্ড ব্যাটারি, ৬০-৭০টি হালকা সাফি ট্যাংক বহরের ১টি রেজিমেন্ট, ২০টি স্যাবর জেটসহ বিমানের ২টি বহর অন্তর্ভুক্ত। তাদের কিছুসংখ্যক গানবোট ও অস্ত্রসজ্জিত নৌযানও ছিল।
পাকিস্তানিদের অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাব ছিল না। দীর্ঘ সময় ধরে নিরাপত্তা বিধান করতে পারবে বলে মনে হয়, এ রকম বিভিন্ন স্থানে তারা অস্ত্রগুলো মজুত করে। বোঝা যায় যে ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের ধারণা কখনো তাদের মনে উদিত হয়নি।
পাকিস্তানি সেনানায়কদের একটি জিনিসের অভাব ছিল, তা হলো দুঃসাহস। সৈন্যসংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, আধুনিক ট্যাংক, দ্রুতগতির গানবোট—সবকিছু নিয়েও তারা পরিখার অন্তরালে নিজেদের স্থবির করে রাখে। এ অবস্থায় আমার পরিকল্পনা ছিল পরিখায় থাকা অবস্থায় তাদের আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকা। যেখানে সম্ভব, তাদের প্রতিরক্ষাব্যূহগুলোকে পাশ কাটিয়ে মুখোমুখি সংঘাত এড়িয়ে যাওয়া।
কারণ, সরাসরি সংঘর্ষে আমাদের মূল্যবান প্রাণহানি ঘটত (প্রতিরক্ষাকারীদের চেয়ে আক্রমণকারীদের প্রাণহানি বেশি ঘটে), আমাদের অগ্রাভিযান মন্থর হয়ে যেত আর যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকত। সম্ভব স্বল্পতম সময়ে আমাদের বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হবে বিধায় দ্রুততার বিষয়টি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিরোধকেন্দ্রগুলোকে পাশ কাটিয়ে তাদের পশ্চাতে ফেলা-সংক্রান্ত আমার রণনীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমি, ‘মূল পথ পরিহার করে পার্শ্বপথ অনুসরণ করো’ শিরোনামে এক বাক্যাংশ উদ্ভাবন করি। সামরিক কৌশলের খ্যাতিমান লেখক ক্যাপ্টেন লিডেল হার্ট একে ‘ছড়িয়ে পড়া প্রবল জলধারা’ বলে অভিহিত করেছেন, যার ব্যাখ্যা হচ্ছে এ রকম, প্রবাহপথে বাধার মুখোমুখি হলে পানি থেমে না থেকে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে আমি ১৯৭১-এর জুনে হালকাভাবে বলেছিলাম যে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত যুদ্ধ বিলম্বিত করতে হবে। ওই সময়ের মধ্যে জমি শুকিয়ে গিয়ে ট্যাংক চলাচলের উপযোগী হবে এবং শীতের তুষারপাত হিমালয়ের ওপার থেকে চীনা বাহিনীর বড় আকারের কোনো আক্রমণে বাধার সৃষ্টি করবে। (প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পরিচালিত ৩ ডিসেম্বরের অতর্কিত বিমান আক্রমণ আমাদের জন্য অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছিল)।
বর্ষাকাল শেষ হওয়ামাত্র সরাসরি যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে ধারণা করে আমাকে বর্ষা মৌসুমেই অভিযানের জন্য প্রশাসনিক সমর্থন, সামরিক লোকবল, সামগ্রী ও সরঞ্জামের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়েছিল। এতে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরে সড়ক ও রেলযোগযোগব্যবস্থা অপর্যাপ্ত ও অনির্ভরযোগ্য এবং শত্রুপক্ষের নিযুক্ত এজেন্টদের অন্তর্ঘাতমূলক কাজের দ্বারা সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি ছিল। পূর্ব দিক থেকে অভিযান চালানোর জন্য আমাদের মূল ঘাঁটি ত্রিপুরায় দীর্ঘস্থায়ী খাদ্যসংকট ছিল।
সেখানে বাইরে থেকে খাদ্য পাঠানো হতো। অবিরত শরণার্থী আগমনে সেখানকার জনসংখ্যা ১৫ লাখ থেকে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। আমাকে কেবল তাদের সঙ্গে সড়ক ও রেলযোগাযোগের সুবিধাগুলো ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হয়নি, বরং কোনো কোনো সময় জনসাধারণকে খাদ্য জোগাতে সামরিক পরিবহন দিয়ে বেসামরিক প্রশাসনকেও সাহায্য করতে হয়েছিল।
এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমরা সীমান্তজুড়ে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রবল বর্ষার মধ্যেও ৫৪ হাজার টন রসদ, গোলাবারুদ, পেট্রল এবং যুদ্ধের জন্য আবশ্যকীয় অন্যান্য সামগ্রীর মজুত সরবরাহ করি এবং যথাযথ কর্মক্ষম কাঠামো প্রদানের জন্য অনেকগুলো প্রশাসনিক ইউনিট সংগঠিত করি। এটা শুধু সম্ভবপর হয়েছিল ভারতীয় রেলওয়ে, সামরিক প্রকৌশলী এবং অন্যান্য প্রশাসনিক সার্ভিসের আন্তরিক এবং দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলেই।
অক্টোবর নাগাদ আমি পাকিস্তানি সমরকৌশল সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত পাই। তদের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। হয় গোটা পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করা এবং আমাদের কাছে যাতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ নগরী বা শহরের পতন না হয়, তা নিশ্চিত করা। অথবা সীমিত পর্যায়ে সীমান্ত এলাকা রক্ষা করে আমাদের সৈন্যদের সামনে অগ্রসর হতে দেওয়া এবং পদ্মা ও মেঘনার তীরে ব্যাপক যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। মনে হয়, জেনারেল নিয়াজি প্রথমোক্ত বিকল্পটি বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর সেনাবিন্যাস আভাস দেয় যে তিনি পুরো দেশটাই রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।
অক্টোবর-নভেম্বর মাস আমি আমার সেনা সংগঠনগুলো পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ এবং ওয়ার গেমে সময় কাটালাম। যেখানে সেনাদল তাদের অভিযান পরিচালনা করবে, তার মডেল বা নকশার সাহায্যে সেনা কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেনা পরিভাষায় তাই হলো ওয়ার গেম। এগুলোর সাহায্যে যাবতীয় সন্দেহ ও আশঙ্কা দূর করা গেল এবং খুঁটিনাটি ত্রুটিগুলো শুধরে নেওয়া হলো।
‘ওয়ার গেম’ চলাকালীন প্রতিরক্ষা–এলাকাগুলো এড়িয়ে আমাদের সমরকৌশল চূড়ান্ত করলাম। আমাদের প্রতিটি ফরমেশনকে তার চূড়ান্ত লক্ষ্য কী এবং কীভাবে তা অর্জন করতে হবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে অবহিত করা হয়। তাদের দৃঢ়তার সঙ্গে দ্রুত এগিয়ে যেতে এবং প্রধান প্রতিরোধকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ পরিহার করতে বলা হয়।
নভেম্বরের শেষ দিকে আমরা পাকিস্তানিদের মোকাবিলায় প্রস্তুত ছিলাম। তবে কীভাবে কখন সংঘর্ষ শুরু হবে বা আদৌ হবে কি না, তা জানা ছিল না। আর যার জন্য প্রার্থনা করছিলাম, সেই উপহার জেনারেল ইয়াহিয়া খান আমাদের দিলেন। যে সময় তিনি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন বলে আমরা প্রত্যাশায় ছিলাম, ঠিক সে সময়ই তিনি তা করলেন।
১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বরের সন্ধ্যা। আমি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে আমার অফিসে। সন্ধ্যা ছয়টায় টেলিফোন বেজে উঠল। দিল্লি থেকে সেনাপ্রধান জেনারেল (পরে ফিল্ড মার্শাল) স্যাম মানেকশ কথা বললেন। তিনি জানালেন যে পাকিস্তান বিমানবাহিনী আমাদের পশ্চিম অঞ্চলের অনেকগুলো বিমানঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করেছে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী সামরিক অভিযান কার্যকর করার নির্দেশ দিলেন।
ঘটনাক্রমে প্রধানমন্ত্রী ওই দিন কলকাতায় অবস্থান করছিলেন, স্যাম মানেকশ প্রধানমন্ত্রীকে পাকিস্তানের আক্রমণের বিষয়টি অবহিত করতে বললেন। আমার চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল (এখন লেফটেন্যান্ট জেনারেল) জ্যাকবকে ফিল্ড অধিনায়কদের সতর্ক করার এবং একটি স্টাফ সভা আহ্বানের অনুরোধ করে বললাম, ‘মেস থেকে সর্বোৎকৃষ্ট ব্র্যান্ডের স্কচ খুঁজে বের করুন, আমি শিগগিরই আসছি।’
গাড়িতে রাজভবনে গেলাম।
সেখানে মিসেস গান্ধী অবস্থান করছিলেন। আমি যখন সেখানে পৌঁছাই, তখন তিনি সবেমাত্র এক সাংস্কৃতিক সমাবেশে বক্তৃতা শেষ করে তাঁর কক্ষে চলে গেছেন। আমি তাঁর কক্ষের দরজায় টোকা দিয়ে প্রবেশানুমতি চাইলাম। অভিবাদন জানিয়ে সেনাপ্রধান থেকে পাওয়া বার্তা তাঁকে পৌঁছে দিলাম।
প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। এটা আমি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে শুনেছি। আমি বিমানে দিল্লি প্রত্যাবর্তন করছি।’ তিনি চিন্তামগ্ন দৃষ্টিতে আলাপে অনাগ্রহী হয়ে মুখ ফেরালেন। নীরবতা ভেঙে আমি বললাম, ‘মিসেস গান্ধী, আপনার জন্য শুভকামনা।’ তিনি হাসিমুখে ঘুরে করমর্দন করে জবাব দিলেন, ‘জেনারেল, আপনার জন্যও শুভকামনা।’
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে ফোর্ট উইলিয়ামস্থ অফিসে প্রত্যাবর্তন করলাম। আমার চিফ অব স্টাফ জেনারেল জ্যাকব মেস থেকে এক বোতল ব্ল্যাক ডগ আনালেন। হুইস্কির বোতলটি টেবিলের চারদিকে বসা স্টাফ অফিসার ও উপদেষ্টাদের সামনে দিয়ে ঘুরে এল। আমরা গ্লাস উঠিয়ে বাংলাদেশের বিজয় কামনা করলাম। আমাদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী সময়ে যুদ্ধ শুরু করায় আমি ইয়াহিয়া খানের জন্যও শুভকামনার প্রস্তাব করলাম। অতঃপর আমরা কাজে মনোনিবেশ করলাম। আমি সর্বাগ্রে যে কাজটি করি তা হলো, আমার অধিনায়কত্বাধীন সৈন্যদের দিনের আদেশ প্রেরণ। সেদিনের বিশেষ আদেশটি ছিল নিম্নরূপ:
‘পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীর অকুতোভয় কর্মকর্তা ও নির্ভীক জওয়ানগণ, ‘নিজ আচার-আচরণের অনুবর্তী হয়ে আজ সন্ধ্যায় পাকিস্তান আমাদের পশ্চিমাঞ্চলের বিমানঘাঁটিসমূহে বিনা প্ররোচনায় আক্রমণ করেছে। আমরা এখন পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধরত। পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীকে আমাদের দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতার নিশ্চয়তা বিধান ও বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কবলমুক্ত করার গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অবশ্যই এই ভূমিকা আমাদের ওপর ন্যস্ত হওয়ায় আমরা বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত।
‘ভারতকে ঘৃণা এবং ধ্বংস করা হলো জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানের প্রিয় রণহুংকার। বাংলাদেশের জনসাধারণের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত বর্বরোচিত, অমানবিক ও গর্হিত নৃশংসতার তুলনা ইতিহাসে নেই। এসব ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের আশ্রয় এবং মাধা গোঁজার ঠাঁই দিয়ে আমরা পাকিস্তানিদের আরও শত্রুতার পাত্র হয়েছি।
‘পাকিস্তানকে একটি সমুচিত শিক্ষা দেওয়া ও তাকে চিরতরে শেষ করার চূড়ান্ত সময় এসেছে। ‘আমি চাই আপনারা প্রত্যেকে ঈশ্বরের ওপর আস্থা রেখে এবং আমাদের উদ্দেশ্যের ন্যায়নিষ্ঠতা সম্পর্কে প্রত্যয়ী হয়ে আপনাদের প্রত্যেকের ও সবার ওপর ন্যস্ত কঠিন কাজ নিষ্ঠা, দৃঢ়সংকল্প, পেশাগত দক্ষতা ও উৎসর্গের মনোভাব নিয়ে সম্পন্ন করবেন। যথাসম্ভব স্বল্প সময়ে আমাদের পূর্ণ সফলতা অর্জন করতে হবে।
‘মনে রাখবেন, আপনারা যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করবেন, তখন বাংলাদেশে মুক্তিদাতা হিসেবে প্রবেশ করবেন, দখলদার হিসেবে নয়। জনসাধারণের সঙ্গে আপনাদের আচরণ হতে হবে বিবেকোচিতভাবে ন্যায্য।
‘আমি আপনাদের প্রচেষ্টার সার্বিক সাফল্য ও মঙ্গল কামনা করি।’ আমার ফিল্ড অধিনায়কদের ফোন করে তাদের প্রস্তুতি যাচাই করে নিলাম। দ্রুততার ওপর জোর দিয়ে আমি তাদের বললাম, আমি চাই তারা যেন পরের দিন সকালবেলা পূর্ণ বিক্রমে শত্রুকে আক্রমণ করে।
বাড়ি ফিরে আমার বিছানা পাঠকক্ষে সরিয়ে নিলাম। সেখানে বাংলাদেশের একটি বড় মানচিত্র ও টেলিফোন ছিল। ভোর পর্যন্ত গভীর ঘুম দিলাম।
পরের দিন ভোরে (৪ ডিসেম্বর) ফিল্ড অধিনায়কদের সামরিক তৎপরতার খবর নিয়ে দ্রুত প্রাতরাশ সেরে ফোর্ট উইলিয়ামে স্টাফ সভা করতে গেলাম। ওই দিনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারির পরে আমার মুখ্য প্রেস সংযোগ কর্মকর্তার অফিসে সংবাদকর্মীদের জন্য প্রেস ব্রিফিংয়ে অংশ নিলাম।
সেখানে দুই শতাধিক বিদেশি ও ভারতীয় সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের অনুরোধে ভারত কীভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছে এবং কেন আমার দেশ বাংলাদেশের জনগণকে তাদের দেশ স্বাধীন করতে সহায়তাদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা ব্যাখ্যা করে একটি বিবৃতি দিই।
তাঁদের জানাই যে আমার প্রধান লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে যথাশিগগির আত্মসমর্পণ করানো। আর তার জন্য আমি সব দিক দিয়ে প্রবল চাপের সৃষ্টি করেছি। তবে আমি কীভাবে লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনা করেছি, তা তাঁদের বলিনি। মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের জবাবদানেও আমি বিরত থাকি। সংবাদ সংগ্রহের জন্য আমাদের অগ্রসরমাণ সৈনিকদের সঙ্গে স্বীকৃত যুদ্ধ-সাংবাদিকদের যাওয়ার অনুমতিদানেরও প্রতিশ্রুতি দিই।
যুদ্ধের প্রথম দিনের প্রায় পুরো সময়ই আমি ফিল্ড অধিনায়কদের কাছ থেকে পরিস্থিতির অগ্রগতি জানতে অপারেশন কক্ষে কাটাই। আমাদের প্রথম সাফল্য আসে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগত সিংয়ের অধীন চতুর্থ কোর আগরতলা থেকে অগ্রসর হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের তিন মাইল অভ্যন্তরস্থ গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগকেন্দ্র আখাউড়া বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে। ৫৭ মাউন্টেইন ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল গনজালভেজ পাকিস্তানি চতুর্দশ ডিভিশনের বিরুদ্ধে এ অভিযান পরিচালনা করেন।
দক্ষিণ-পশ্চিমে লেফটেন্যান্ট জেনারেল রায়নার নিয়ন্ত্রণাধীন দ্বিতীয় কোর যশোর ও ঝিনাইদহের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। নবম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল দালবির সিং যশোর আক্রমণ করেন আর বিখ্যাত চতুর্থ ডিভিশনের নেতৃত্বদানকারী মেজর জেনারেল মহিন্দর সিং ব্রার ইতিমধ্যে জীবননগর মুক্ত করে দর্শনায় পাকিস্তানিদের আক্রমণ করেন। মেজর জেনারেল আনসারীর অধীন নবম পাকিস্তানি ডিভিশন ভালোভাবেই আক্রমণ প্রতিহত করছিল, তবে মনে হয় আমাদের চতুর্থ ডিভিশনের চাপের মুখে তারা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
উত্তর-পশ্চিম সেক্টরের কোর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল থাপান আমাকে অবহিত করেন যে ২০ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল লচমন সিং লেহি হিলি মুক্ত করতে পাকিস্তানি ১৬ ডিভিশনের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই করছেন। অবশ্য উত্তর দিকে ব্রিগেডিয়ার এফ এন কাথপালিয়ার অধীন ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেড পাকিস্তানিদের কাজ থেকে পঞ্চগড় ছিনিয়ে নিয়ে দিনাজপুর অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিল।
আমাদের প্রথম বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটে কেন্দ্রীয় সেক্টরে। ওখানে আমাদের সৈনিকেরা কামালপুর কবজা করার পর পাকিস্তানিদের পোঁতা মাইনের ওপর দিয়ে জিপ চালিয়ে যাওয়ার সময় সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং পায়ে মারাত্মক আঘাত পান। তবে ব্রিগেডিয়ার হারদেব সিং ক্লার তাঁদের জামালপুরমুখী অভিযান অব্যাহত রাখেন।
যদিও প্রথম দিনে আমরা স্থলভাগে দৃশ্যমান কিছু অর্জন করিনি, তথাপি সবকিছু পরিকল্পনামাফিক চলছিল। এদিকে আমাদের বিমানবাহিনী প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ভালো করছিল। উপর্যুপরি সফল বিমান আক্রমণে তারা আকাশযুদ্ধে প্রাধান্য বিস্তার করে।
অন্যান্য অনেক সন্ধ্যার মতো ওই দিন সন্ধ্যাবেলায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাবু জগজীবন রাম আমাকে ফোন করলেন। তিনি বলতে গেলে কোনো প্রশ্নই করলেন না, বরং সারাক্ষণই উৎসাহব্যঞ্জক কথা বললেন।
প্রতিরক্ষাসচিব কে বি লাল অভিযানের সর্বশেষ সংবাদ জানতে এবং আমাকে অভিনন্দন জানাতে ১২ দিনে তিনবার ফোন করেন। আমি জেনারেল স্যাম মানেকশর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করছিলাম। তিনি প্রতিদিন খুব সকালেই সামরিক অভিযানের বিস্তারিত অগ্রগতি জানতে সবার আগে আমাকে ফোন করতেন।
ঢাকার দিকে আমাদের অগ্রাভিযানে স্থানীয় জনসাধারণ এবং মুক্তিবাহিনী ব্যাপকভাবে সহায়তা করে। তারা নৌযান, গরুর গাড়ি, সাইকেল-রিকশা চালিয়ে শারীরিক শক্তি ব্যবহার করে, সর্বোপরি মূল্যবান তথ্য প্রদান করে আমাদের ঢাকা অভিমুখী অভিযান অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে।
এটা অবিশ্বাস্য যে ১২ দিনের যুদ্ধ শেষে, যদিও তখনো বেশির ভাগ পাকিস্তানি বাহিনী অক্ষত ছিল, আমরা সাফল্যের সঙ্গে দিনাজপুর, সৈয়দপুর, রাজশাহী, পাবনা, খুলনা, সিলেট, ভৈরববাজার, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে তাদের ছত্রভঙ্গ করে ফেলি। ১৫ ডিসেম্বর আমরা যখন ঢাকায় পৌঁছাই, তখন ঢাকা ছিল অরক্ষিত।
আমাদের সমরকৌশল ভালো ফল দেয় এবং এটি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাফল্যমণ্ডিত হয়। ১৫ তারিখ ঠিক সকাল ১০টায় কলকাতার বিদেশি কনস্যুলার প্রতিনিধির একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য আমাকে ফোন করেন। তিনি জানতে চাইলেন যে পাকিস্তানি সেনানায়ক যুদ্ধবিরতির শর্তাদি নিয়ে আলোচনার জন্য আমাকে প্রস্তাব দিয়েছেন কি না। আমি তৎক্ষণাৎ জেনারেল মানেকশর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি। তাঁর কাছেও এ ধরনের পদক্ষেপ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য ছিল না। এক ঘণ্টা বাদে একই কূটনীতিক আমাকে টেলিফোনে প্রদত্ত তাঁর পূর্বের বার্তা উপেক্ষা করার অনুরোধ জানালেন।
ওই দিন বেলা ২টা ৩০ মিনিটে জেনারেল মানেকশ টেলিফোনে আমাকে অবহিত করেন যে নিয়াজির কাছ থেকে একটি বার্তা পাওয়া গিয়েছে। তিনি তাঁকে অনতিবিলম্বে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বার্তাটির জবাব দিয়েছেন। সদিচ্ছার প্রমাণ হিসেবে আমরা পরের দিন সকাল নয়টা অব্দি ঢাকায় বোমাবর্ষণ স্থগিত রাখলাম। বুঝতে পারলাম যে যুদ্ধের সমাপ্তি নিকটবর্তী।
আমরা আত্মসমর্পণ কীভাবে সংঘটিত হয়, তা সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করার কাজে লেগে গেলাম। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী পরাজিত অধিনায়ক বিজয়ীর সদর দপ্তরে এসে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেন। এমনকি জেনারেল ম্যাকার্থার আত্মসমর্পণ ঘটানোর উদ্দেশ্যে জাপান পৌঁছানোর পরও জাপানি অধিনায়ককে তাঁর জাহাজে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। আমাকে ঢাকায় গিয়ে পরাজিত অধিনায়কের আত্মসমর্পণ গ্রহণ করতে হয়।
প্রস্তাব দেওয়া হয় যে জেনারেল নিয়াজি ঢাকা বিমানবন্দরে আমার আগমনের জন্য অপেক্ষা করবেন ও সেখানে আত্মসমর্পণপত্রে স্বাক্ষর করবেন। আমি এ প্রস্তাব নাকচ করে সিদ্ধান্ত নিই যে যেহেতু এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, তাই এই আত্মসমর্পণের ঘটনাটি যত বেশি সম্ভব মানুষের প্রত্যক্ষ করা উচিত। আমি রেসকোর্স ময়দানকে স্থান হিসেবে বেছে নিলাম।
১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার ঠিক আগে বেলা ৩টা পর্যন্ত বোমাবর্ষণ স্থগিত রাখার সময়সীমা বর্ধিত করা এবং আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া স্থির করতে ঢাকায় একজন প্রতিনিধি পাঠানোর অনুরোধসহ নিয়াজির বার্তা পেলাম। আমার স্টাফ সভা চলছিল। বার্তাটি সভায় উপস্থাপন করে আমার কর্মকর্তাদের জানালাম যে যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি। আমি তাদের গভীর নিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম ও মূল্যবান সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলাম। দিল্লিতে সেনাবাহিনী প্রধানকে বিষয়টি অবহিত করা হলে তিনি আত্মসমর্পণের খসড়া তাঁকে পাঠাতে বললেন।
আমরা আত্মসমর্পণের শর্তাবলির খসড়া তৈরি করে অনুমোদনের জন্য দিল্লি প্রেরণ করলাম। অনুমোদনকৃত চূড়ান্ত খসড়া পাওয়ার পর এর অনেকগুলো অনুলিপি প্রস্তুত করা হলো।
আমি একজন কর্মকর্তাকে কুচকুচে কালো কালিভর্তি মোটা নিবের খুব মজবুত একটি কলম সংগ্রহের জন্য বাজারে পাঠালাম। তিনি একটি সেফার কলম নিয়ে এলেন। পরে আত্মসমর্পণের শর্তাদি চূড়ান্ত করতে জেনারেল জ্যাকবকে ঢাকায় পাঠানো হলো।
আমি কিছুটা উদ্বেগপূর্ণ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। কারণ, যে সময় জ্যাকরের ঢাকা পৌঁছার কথা, তার অনেকক্ষণ পরও তাঁর কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। তাঁর অবস্থান খুঁজে বের করতে নিয়াজিকে বার্তা পাঠালাম। তাঁর স্বস্তিদায়ক জবাব ছিল, ‘আপনার স্টাফ অফিসার আমাদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজন করছেন। অনেক সালাম।’
পরবর্তী সমস্যা ছিল আমার ঢাকা পৌঁছানো নিয়ে। বিমানবন্দরের ওপর ব্যাপক বোমাবর্ষণ হওয়ায় সেখানে ছোট বিমান অবতরণও নিরাপদ ছিল না। আমি নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে আমার সমমানের কমান্ডার ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণান, এয়ার মার্শাল এম সি দেওয়ান, আমার স্ত্রী এবং বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে একজন প্রতিনিধি মনোনীত করলাম। দুর্ভাগ্যবশত প্রধান সেনাপতি কর্নেল (বর্তমানে জেনারেল) ওসমানী অন্যত্র ছিলেন। বিমানে মুক্ত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আগরতলা গেলাম। সেখানে হেলিকপ্টারে স্থানান্তরিত হয়ে ১১টি হেলিকপ্টারের বহরসহ বিকেল ৪টার কিছুক্ষণ পর ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম।
জেনারেল জ্যাকবসহ জেনারেল নিয়াজি বিমানঘাঁটিতে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। সেখানে প্রচুর জনসমাগম হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে কয়েক ডজন সাংবাদিকও ছিলেন। একজন বেশ খোলাখুলি জিজ্ঞেস করলেন, আত্মসমর্পণের ব্যাপারে নিয়াজিকে নিয়ে আমি কোনো অস্বস্তিতে ছিলাম কি না। আমি খোশমেজাজে জবাব দিলাম যে তাঁরা আমাকে একটি কথা বলারও সময় দেননি।
আমার স্ত্রী ও আমি নিয়াজির সঙ্গে তাঁর গাড়িতে উঠলাম। জনতা তীব্রবেগে গাড়ির দিকে দৌড়ে এসে ইংরেজিতে ‘জানোয়ার, জানোয়ার’ রবে চিৎকার শুরু করল। আমি মনে করলাম, পাকিস্তানি জেনারেলের চেয়ে তাদের আমাকে দেখার সুযোগ দেওয়াই উত্তম। সঙ্গে সঙ্গে তাদের মনোভাব পরিবর্তিত হলো। জনতা ‘জয় বাংলা! ইন্দিরা গান্ধী, জিন্দাবাদ! ভারতীয় সেনাবাহিনী, জিন্দাবাদ! জেনারেল অরোরা, জিন্দাবাদ!’ ধ্বনি দিয়ে চিৎকার করতে থাকল।
অনেক নারীসহ বিপুল জনতার উপস্থিতিতে পূর্বনির্ধারিত রমনা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হলো। আমার স্ত্রীকে জানানো হয় যে কয়েক মাস পর কোনো ভদ্রমহিলা বাইরে বেরোতে সাহসী হয়েছেন। জেনারেল নিয়াজি শর্তগুলো পড়ে আত্মসমর্পণপত্রে স্বাক্ষরের পর আমি তাতে প্রতিস্বাক্ষর করলাম। পরে তিনি দাঁড়িয়ে তাঁর রিভলবারের বাঁধন খুলে আমাকে হস্তান্তর করলেন।
জনতা আবারও নিয়াজির কাছে যেতে চেষ্টা করল। নিরাপত্তার জন্য আমরা তাঁর চারপাশে বেষ্টনী তৈরি করলাম। আমি তাঁকে জানালাম যে নিরাপত্তার খাতিরে আমরা এখনই তাঁদের কর্মকর্তা ও সৈনিকদের নিরস্ত্র করব না। এটা জেনারেল সগত সিংয়ের আদেশে করা হবে। পরবর্তী সময়ে নিয়াজি তাঁর কাছ থেকে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা পাবেন।
ঢাকা বিমানবন্দরে জেনারেল নিয়াজি আমাদের বিদায় জানালেন। আগরতলা থেকে জেনারেল মানেকশর সঙ্গে কথা বলে তাঁকে আত্মসমর্পণের বিশদ বিবরণ দিলাম।
যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশে আমার দায়িত্ব শেষ হয়নি। ১০ মিলিয়ন শরণার্থীর নিজ বাসভূমিতে প্রত্যাবর্তন, আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসনের ক্ষমতাসীন হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে আমাকে মনোযোগী হতে হয়। বেসামরিক যোগাযোগের দায়িত্বে থাকা আমার প্রধান স্টাফ অফিসার মেজর জেনারেল সরকার একটি ক্ষুদ্রাকার সদর দপ্তরসহ ঢাকায় স্থানান্তরিত হন।
এই মুক্তিযুদ্ধে কী পরিমাণ জীবন ও অস্ত্রশস্ত্রের ক্ষতি হয়েছিল? আমাদের হিসাবমতে, ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরুর আগেই মুক্তিবাহিনী ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক বাহিনীর হাতে আনুমানিক ৮ হাজার পাকিস্তানি হতাহত হয়। আমাদের বিরুদ্ধে ১৪ দিনের যুদ্ধে তাদের ২ হাজার ২৬১ জন সৈন্য প্রাণ হারায়। আহত হয় প্রায় ৪ হাজার। অধিকন্তু আমাদের হাতে তাদের আধা সামরিক বাহিনীর ৭১৯ জন লোক নিহত ও ৩১৪ জন আহত হয়। আমাদের কাছে বন্দী ৯১ হাজারের মধ্যে ৫৪ হাজার ৪৫০ সেনাবাহিনী, ১ হাজার ৪০০ নৌবাহিনী, ৮৩৫ বিমানবাহিনী এবং ১২ হাজার ১৯২ জন আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিল।
পাকিস্তানের সামরিক সাজ-সরঞ্জামের ক্ষতির পরিমাণও ছিল উল্লেখযোগ্য: তন্মধ্যে ৬৯টি সাফি, ৫টি পিটি ৭৬ ও ৩টি শেরমান ট্যাংক (খোয়া যায় বা বিধ্বস্ত হয়); কামান ও ভারী মর্টার ৫০টি, ১০৪টি রিকয়েললেস কামান অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাংলাদেশে তাদের ২০টি যুদ্ধবিমানের সব কটিই বিনষ্ট হয়।
আমাদের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ১ হাজার ৪৭৮ জন নিহত ও ৪৭ জন নিখোঁজসহ (মৃত বলে ধরে নেওয়া) ১ হাজার ৫২৫ জন নিহত এবং ৪ হাজার ৬১ জন আহত হয়। আমাদের ১০ থেকে ১৪টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়। আমাদের সেনাবাহিনী এবং রণাঙ্গনের অধিনায়কদের দক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধ করার গুণাবলি ও ভারতীয় বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীর অত্যন্ত মূল্যবান অবদানের কাছে আমরা যুদ্ধজয়ের জন্য ঋণী।
(সংক্ষেপিত)
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতের বিখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক খুশবন্ত সিং জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকার নেন এবং অরোরার জবানিতে একটি স্মৃতিচারণামূলক রচনা দাঁড় করান। এটি খুশবন্ত সিং তাঁর খুশবন্ত সিং অন ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ (দিল্লি, ১৯৭৬) গ্রন্থে সংযুক্ত করেন। এ লেখার উল্লেখযোগ্য অংশ প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত মতিউর রহমান সম্পাদিত ১৯৭১: শত্রু ও মিত্রের কলমে (২০২০) বইয়ে সংকলিত হয়েছে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা: মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক।