শতবর্ষে এস এম সুলতান 

এস এম সুলতান ( ১৯২৪ – ১৯৯৪)
ছবি : নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম

আজ ১০ আগস্ট শিল্পী এস এম সুলতানের ১০০ বছর। শতবর্ষকে কেন্দ্র করে উদ্‌যাপিত হতে যাচ্ছে নানা আয়োজন। শতবর্ষে সুলতান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্‌যাপন কমিটি গঠিত হয়েছে। ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার অধিকারী এই বোহেমিয়ান শিল্পীর অগণিত শিল্পকর্ম আঁকার পর আর কেউ দেখেনি। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে তাঁর চিত্রাবলির সামান্য অংশ আমরা দেখতে পাই, আরও বহু ছবি কীভাবে কোথায় কার কাছে সংরক্ষিত আছে, সেটা আমাদের অজানা। জীবিতকালে তিনি নিজেও তাঁর শিল্পকর্ম সংরক্ষণে তাগিদ দেখাননি। ছবি এঁকেছেন, তারপর সেটি কোথায় থাকবে, কার কাছে যাবে, সে চিন্তা তাঁকে কখনোই বেসামাল করেনি। নিজের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পসম্ভারের দিকে কেন তিনি এত নিস্পৃহ থাকতে পারলেন এবং ছবি আগলে রাখতে একপ্রকার উপেক্ষাই করলেন। এর উত্তর এখনো জানা যায়নি, অথচ তাঁর ছবির ক্যানভাসের বিষয়কে পৃথিবীর সামনে এমন দর্শনবিদ্যার প্রলেপে সৃজন ও উপস্থাপন করেছেন, যা আমাদের বিস্ময় জাগায়। সুলতান কেন তাঁর বিষয়কে ও ছবির পরতে পরতে চিন্তা ও দর্শনকে এমনভাবে প্রোথিত করে গেলেন, ভাবলে তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর মেলে না।

এস এম সুলতানের কুহেলিকাময় জীবন ও ব্যতিক্রমী শিল্পকর্মকে যুক্ত করে তাঁর কোনো পূর্ণাঙ্গ জীবনী এখন পর্যন্ত রচিত হয়নি। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন অনেকে, কিন্তু পরিপূর্ণ সুলতান যেন ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে সিংহভাগ। শিল্প সমালোচকদের অন্তরালে তাঁর অনেক ছবি অজ্ঞাতবাসে। শতবর্ষকে উপলক্ষ করে এসব হারিয়ে যাওয়া ছবির তত্ত্বতালাশ চলছে। সেসব ছবি যা আমরা এখনো দেখিনি, সেগুলোর যদি কখনো সন্ধান পাওয়া যায়, হয়তো আরেক সুলতানকে আমরা আবিষ্কার করতে সক্ষম হব। এমন আশা থেকে এমনও হতে পারে, পূর্ণাঙ্গ সুলতানকে জানতে হলে আমাদের হয়তো আরও অর্ধশতাব্দী অপেক্ষা করতে হতে পারে। এই জন্য যে তিনি নিজেই নিজেকে অপ্রকাশিত রাখার সব কৌশল বহাল রেখেছিলেন। কখনোই নিজেকে মেলে ধরেননি। এমন শিল্পী আমাদের এই উপমহাদেশের শিল্পকলার ইতিহাসে আর নেই।

শিল্প সমালোচকেরা অনেক লিখেছেন কিন্তু তাঁকে ও তাঁর ক্যানভাসকে তাঁরা গভীর খনন করতে পেরেছেন বলে মনে করি না। শতবর্ষের মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত হয়ে এই আদর্শিক শিল্পী ও দার্শনিকের ছবির সামনে দাঁড়ালে সাধারণভাবে মনে হতে পারে, এই শিল্পকর্ম শুধু আমাদের ভূগোলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, পৃথিবীর সাম্যবাদী সমাজের যেকোনো জাতির যাপিত জীবনের ছবি বলে মনে হতে পারে। এমন আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট–সংশ্লিষ্ট দাবি বাংলাদেশে একমাত্র সুলতানের শিল্পকর্ম করতে পারে দ্বিধাহীনভাবে।

নড়াইলের চিত্রা নদীর পারের মাছিমদিয়া গ্রামে ১০ আগস্ট ১৯২৪-এ জন্ম নেওয়া লাল মিয়া কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়ে শিল্পী হতে যে স্বপ্নবীজ রোপণ করেছিলেন, ১৯৭৬-এ আঁকা তাঁর আইকনিক ছবি ‘ফার্স্ট প্ল্যান্টেশন’ এখন আমাদের দেশের পরম জাতীয় সম্পদ। কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন মাত্র ২৫ বছরে এবং শেষতক জাতির স্বপ্নে নির্মাতা, প্রেম ও ভালোবাসার প্রবক্তা হয়ে তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে স্থায়ী হয়ে রয়েছেন। জয়নুল, কামরুল, সুলতান—এই ত্রয়ী আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে দেশের শিকড়ের দিকে আহ্বান করেছেন। জীবিত সুলতানের চেয়ে প্রয়াত সুলতান অধিক মহিমান্বিত হয়েছেন।

দেশের এই সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক পর্বে শিল্পী সুলতান উল্লেখযোগ্য ও প্রাসঙ্গিক। বৈষম্যবিরোধী সাম্য ও সুন্দরের স্বমিশ্রিত শিল্পভাষার মহান চিত্রশিল্পী সুলতান, যিনি এককভাবে কৃষিসভ্যতার অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন তাঁর ক্যানভাসে। ভূমিব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ও কৃষকের পীড়িত আর্তনাদ যেন তাঁর ছবিতে প্রবলভাবে আর্তনাদ করে। তেলরঙে বর্ণিল ক্যানভাসে কৃষকের বিপুল শক্তিকে তিনি মহাকালের আর্কাইভ রেখে গেলেন এবং দেখাতে চাইলেন দরিদ্র কৃষক দুর্বল নয়। দ্রোহ তাঁর ছবিতে আটকে রাখলেন, যা আমাদের গন্তব্যে যেতে অভ্যর্থনা জানাতে চায়। শতবর্ষে সুলতান ও তাঁর ছবি যেন তাঁর জীবনদর্শন ও কর্মের এক মহাকালিক ভ্রমণের চিন্তার বয়ান। এস এম সুলতান জন্মশতবার্ষিকীতে জাতীয় ঐক্য ও সামাজিক সংস্কার একাত্ম হয়ে এমন এক মোহনায় মিলিত হোক, যেখানে তার স্বপ্নের সাফল্যের আলো যেন আমরা দেখতে পারি।