যাঁরা ঈদে বাবা-মার কাছে যান, তাঁরাই সবচেয়ে ভাগ্যবান

বাবা–মায়ের সঙ্গে লেখক ও তাঁর ভাই–বোনেরা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আপনাদের যাঁদের বাড়ি আছে, বাবা-মা আছেন, ঈদে কর্মশহর ছেড়ে শিকড়-শহর/গঞ্জ/গ্রাম/জনপদে যাওয়ার জায়গা আছে, ঘরদোর আছে, গিয়ে মিলিত হওয়ার মানুষ আছে, আপনজন আছে, আপনাদের মতো সৌভাগ্যবান আর কেউ নেই! বছরের এই সময়টায়, ঈদের আগে বাড়ি যাওয়ার একটা আলাদা মাহাত্ম্য আছে, আমেজ আছে। টিকিট জোগাড় করা, ভিড় হবে কি হবে না, কত ঘণ্টার পথ কত ঘণ্টায় পাড়ি দিতে হলো, সেই সব হিসাব-নিকাশ, ধকল, কষ্ট ইত্যাদি তো অভিজ্ঞতার ঝুড়িতে সঞ্চয় হয়ই, কিন্তু একটা সময় এগুলোই হয়ে থাকবে মধুর স্মৃতি।

কষ্টের পরেই তো সেই ব্যাখ্যার অতীত আনন্দ। শৈশবের স্মৃতিমাখা সেই পথঘাট, সেই বাজে পোড়া গাছ, পরিচিত পুকুর, পাড়ার দোকান, সেই মসজিদ, সেই সাঁকো, পড়শিদের সেই ঘোরদোর, তারপর আমগাছ, নিমগাছ, শজনেগাছে ঢাকা সেই বাড়ি! আর সেই বাবার পাঞ্জাবির গুটিয়ে রাখা হাতা, মায়ের শাড়িতে মসলা কিংবা পানের ঘ্রাণ।

আব্বা মারা গেছেন সেই ১৯৮৬ সালে, আম্মা মারা গেছেন ২০১৮ সালে, তারপর আমাদের আর যাওয়ার জায়গা নেই। আগে আমরা সব ভাইবোন মিলে রংপুর যেতাম। রংপুরে আম্মা থাকতেন।

১৯৮৬ সালের আগে, আমরা সবাই ছাত্র, রংপুরের বাসায় যেতাম ঈদে। বড় আম্মাও বেঁচে ছিলেন। আমাদের ছাত্রত্ব ঘুচতে লাগল। বড় ভাই ডাক্তারি পাস করে রংপুর মেডিকালে ইন্টার্ন করতে লাগলেন। তারপর চলে এলেন পিজিতে, এফসিপিএস করতে। মেজ ভাই রাজশাহী বিআইটিতে জয়েন করলেন। বোন মেডিকেল পাস করে ঢাকা এলেন এফসিপিএস করতে। আমি বুয়েট থেকে বেরিয়ে বিসিএস দিচ্ছি, আর ভোরের কাগজ করছি। ১৯৯০-এর দশক। তারপর এক এক করে ভাইবোনদের বিয়ে হচ্ছে। আমাদেরও ছেলেপুলে হচ্ছে।

আমার মনে আছে, ২০০৭ সালে আমরা রংপুর জিলা স্কুলের ১৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে সবাই রংপুর গেলাম। ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া হলো, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, শিল্পী সুবীর নন্দী প্রমুখকে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে আমাদের বাসায় নিয়ে গেলাম। তখন আমাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে পড়ে। বাসা গমগম করছে। সায়ীদ স্যার বললেন, ‘তোমাদের বাসাটা তো চাঁদের হাট!’

আব্বা রংপুর মুন্সিপাড়া গোরস্তানে। বড় আম্মা মুন্সিপাড়া গোরস্তানে। করোনার আগে আগে ছোট আম্মাও বিদায় নিলেন।

এখন আমরা, পাঁচ ভাইবোনই ঢাকা। আমাদের বাচ্চারাও বিদেশ যাওয়া শুরু করেছে। তিন ভাইয়ের তিন সন্তান বিদেশে।
এখন আমরা বাচ্চাদের মিস করি।

আর আমরা, বড়রা মিস করি, সেই রংপুর! সেই যে আমার মেজ ভাই আশরাফুল হক টিকিট কেনার জন্য সারা রাত কমলাপুর রেলস্টেশনে পেপার বিছিয়ে বসে থাকতেন! সাহ্‌রি সেরে গাবতলী যেতেন বাসের টিকিটের জন্য। কী যে কষ্ট হতো! সকালের বাসের টিকিট কেটে বাসের কাউন্টারে গিয়ে শোনা গেল, রাতের বাসই ছাড়েনি। বসে থাকো, বসে থাকো।

সন্ধ্যা ছয়টায় রংপুর পৌঁছানোর কথা, পৌঁছলাম রাত তিনটায়। তখনো আম্মারা জেগে। শাড়ি সামলাতে সামলাতে গেট খুলবেন!
খুলেই প্রথম প্রশ্ন করবেন, ‘এত দেরি হলো! হাতমুখ ধুয়ে নে। খেতে বস।’
আমাদের আম্মারা কোনো দিন কি আমাদের ঠান্ডা খাবার খেতে দিতেন?
তখন তো ওভেন ছিল না। রংপুরে গ্যাসও ছিল না। খাবার গরম আসত কোন জাদুবলে!
আর সেই গল্প, যা আপনাদের অনেকবার শুনিয়েছি, আমরা খেতাম, আম্মারা আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আমাদের গলা দিয়ে খাবার নামলে সেই খাবার তাঁদের পেটে গিয়ে পড়ত, তাঁদের পেট ভরত।

আমার আব্বা যখন মারা যান, আমরা পাঁচ ভাইবোনও ছাত্র।
আব্বা রিটায়ার করেছেন। খুব সামান্য আয়। বড় ভাই ইন্টার্ন করতে শুরু করলেন। আমরা মোটামুটি অগাধ জলেই পড়েছিলাম।

আমরা কিন্তু ঈদে নতুন কাপড় পেতাম না। সারা বছরের প্রয়োজনীয় পোশাক, জুতা হয়তো ঈদের আগে কিনে দেওয়া হতো। এ ঈদে শার্ট নিয়েছ, পরের ঈদে বাটার স্যান্ডেল-শু। কাজেই নতুন কাপড় লুকিয়ে রাখা, সেই বিলাসিতা আমাদের ছিল না।
আব্বা আম্মাদের বলতেন, ‘এই অভাব তো থাকবে না! তোমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হবে, মানুষ হবে। প্রতি ঈদে দেখবা, তিনটা করে শাড়ি পাবা।’

আহা, আমার আব্বা! আমি যখন বুয়েটে ফার্স্ট ইয়ার, মুনমুন আপা রংপুর মেডিকেলে থার্ড ইয়ার, আশরাফ ভাই বুয়েটে ফোর্থ ইয়ার, বড় ভাই ইন্টার্ন করছেন, ছোট ভাই আনোয়ারুল হক মিলন কেবল স্কুলে, ক্লাস থ্রিতে, আব্বা মারা গেলেন।

আব্বা দেখে যেতে পারলেন না, তাঁর ছেলেমেয়েরা কে কী করছে! আব্বা খুব চাইতেন আমি ছবি আঁকি, কবিতা লিখি, নাটক লিখি, বিতর্ক-বক্তৃতা করি--আমার একটা বইও আব্বা দেখে যেতে পারেননি। বাড়িভরা ডাক্তার, আব্বার ছেলে-মেয়ে, পুত্রবধূ, জামাই, নাতি-নাতনিরা ডাক্তার--ডাক্তারে বাড়ি গিজগিজ করছে, অথচ হার্ট অ্যাটাকে আব্বা মারা গেলেন, ঠিকঠাক চিকিৎসা পেলেন না।

মা বেঁচে থাকতে যখন ভাই–বোন ও সবার সন্তানদের নিয়ে বাড়িতে চাঁদের হাট বসত

আমার মনে আছে, আমি প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র, পিটিআইতে, স্কুলের বিচিত্রা অনুষ্ঠানে নিজে হাসির নাটিকা লিখে নিজেই অভিনয় করতাম, আব্বা সেটা দেখে বাসায় এসে বলতেন, ‘বাবা, ওইটা আবার করে দেখাও তো।’ বিতর্ক করে পুরস্কার নিয়ে এলে বলতেন, ‘বাবা, কী বলেছ, আবার বলো!’ আব্বাকে পুরা বক্তৃতা আবার শোনাতে হতো।

আর পেয়েছি আদর। শুকনা কাঠি ছিলাম, মাথাটা ছিল বড়, যেখানেই যেতাম, খালি আদর পেতাম; বড় ভাই আমাকে খুব আদর করতেন, মেজ ভাই করতেন, মুনমুন আপা করতেন, আব্বা–আম্মারা করতেন, জিলা স্কুলের শিক্ষকেরা করতেন, আবুল হোসেন স্যার ক্লাস এইটের ছাত্র আমাকে কোলে করে হেডস্যারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, আবদুল আলীম স্যার আদর করতেন, কারমাইকেল কলেজের স্যারেরা আদর করতেন, এমনকি গার্লস স্কুলের টিচাররাও স্নেহ করতেন। আর আমাদের সবার আদর ছিল ছোট ভাই মিলনের জন্য।

এখন, ঈদে আবার সবাই একখানে হব। সবাই তো ঢাকায়, মোটামুটি ধানমন্ডি–লালমাটিয়া এলাকাতেই থাকি। বিদেশে থাকা সন্তানদের মিস করব।

কিন্তু সেই যে ঈদের আগে রংপুর যাওয়া, গাবতলী পার হলেই শুরু হলো যানজট, কখন বাস নড়বে, কেউ জানে না, এখন সেটাই মধুর বলে মনে হচ্ছে!

আগে, আব্বা বেঁচে থাকতে, সব ভাই মিলে যেতাম ধাপের মসজিদে নামাজ পড়তে। আর আব্বা মারা যাওয়ার পর নামাজ শেষে সবাই মিলে যেতাম মুন্সিপাড়া কবরস্থানে।
এখন আর ঈদ এলে রংপুর যাওয়া হয় না। আপনাদের ‘মায়া’ করছি, যাঁদের বাবা-মা বেঁচে আছেন, যাঁদের ঈদে যাওয়ার মতো বাড়ি আছে, শিকড় আছে, শিকড়ের টান আছে। আমাদের অফিসের সহকর্মী অনেকেই ঈদে বাড়ি যাচ্ছেন, আমার দেখতেই ভালো লাগছে।

আমার আব্বার ছিল ডায়াবেটিস। তিনি নিজে মিষ্টি খেতে পারতেন না। সে জন্য আমাদের ভাইবোনদের মিষ্টির দোকানে বসিয়ে সবচেয়ে বড় বড় মিষ্টি খাওয়াতেন। আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আমরা খেলেই তাঁর মিষ্টি খাওয়া হয়ে যেতে। আজকে আমারও সেই দশা। আমার সহকর্মীরা ঈদে বাড়ি যাচ্ছেন, তাঁদের দিকে তাকিয়ে থেকে আমারও ঈদে বাড়ি যাওয়া হয়ে যাচ্ছে। আমার বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না, ওদের তো হচ্ছে! ওদের তো বাবা-মা আছেন!

বাংলাদেশের ঈদের সেরা একটা দিক হলো ঈদে শৈশবের স্মৃতিমাখা বাড়ি যাওয়া, সংবাদপত্রের ভাষায়, নাড়ির টানে বাড়ি যাওয়া। শৈশবের স্মৃতি হলো মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, যেটা সে গোপন দরজার আড়ালে নীরবে আগলে রাখে, ঈদ সেই দরজার সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়।

আমাদের সবচেয়ে মধুর স্মৃতি হলো সেসব, যা আমাদের সবচেয়ে বিষণ্ন সুরগুলো শোনায়।