সরকারি-বেসরকারি ৯০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে গত বছরের জুলাই থেকে গত মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে সরকার ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বা কেন্দ্র ভাড়া দিয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া দিতে হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা।
জাতীয় সংসদ ভবনে গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানায়।
অনেক সময় কোনো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস রেখে ভাড়া দিতে হয় বলে এই ক্যাপাসিটি পেমেন্ট নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, দেশে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি। এ কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্টবাবদ সরকারকে অনেক বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া হিসাবে বলা হয়েছে, এই কেন্দ্র ভাড়ার মধ্যে সরকারি কোম্পানিগুলোকে আলোচ্য ৯ মাসে দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকার মতো। প্রায় ১২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে। এর মধ্যে ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার (আইপিপি), ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (রেন্টাল, কুইক রেন্টাল) ও আমদানি করা বিদ্যুৎ রয়েছে।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এর আগে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ২০২০-২১ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হয়েছিল ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকার কিছু বেশি। এর আগের অর্থবছরে দিতে হয়েছিল ১৮ হাজার ১২৩ কোটি টাকার মতো।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বলছে, দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা মোট ২১ হাজার ৩৯৬ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ বাদে)। সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছিল গত ২২ এপ্রিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় দাবি করে থাকে, উৎপাদন ক্ষমতা প্রয়োজনের তুলনায় খুব একটা বেশি নয়।
তবে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, এর আগে কেন্দ্রভাড়া নিয়ে যে তথ্য এসেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় হচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে সরকারি হিসাবে। সংসদীয় কমিটিতে হিসাব আসা ও তা নিয়ে আলোচনা হওয়া ইতিবাচক একটি দিক। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ৪০ থেকে ৪৮ শতাংশ অব্যবহৃত থাকে। কেন্দ্রভাড়াবাবদ বিপুল অঙ্কের ব্যয়ের বড় কারণ এটি। বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ভাড়া দেওয়ার মতো বিলাসিতা করার সুযোগ বর্তমান পরিস্থিতিতে আর নেই।
কেন্দ্রভাড়া বাবদ ব্যয় কমাতে তিনটি পরামর্শ দেন গোলাম মোয়াজ্জেম। প্রথমত, মেয়াদকাল শেষে ভাড়াভিত্তিক ও অদক্ষ কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, নতুন কেন্দ্রের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ না নিলে টাকা নয়, এমন চুক্তি করা। তৃতীয়ত, বর্তমান কেন্দ্রের ক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট নিয়ে দর-কষাকষি করা।
সূত্র বলছে, বৈঠকে জানানো হয়, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, রুরাল পাওয়ার কোম্পানি, বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি, নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ও আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির মোট ২৮টি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের বিপরীতে মোট ১ লাখ ১১ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৮ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
বৈঠক শেষে সংসদ সচিবালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পগুলোর বিপরীতে নেওয়া বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিকল্পনা সম্পর্কে বৈঠকে আলোচনা হয়। এ ছাড়া বৈঠকে ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদান সম্পর্কিত তথ্য তালিকা আকারে কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়।
বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ঋণের বিপরীতে ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধে প্রবিধান রাখার পরামর্শ দেয় সংসদীয় কমিটি। এ ছাড়া সরকারি স্থাপনাগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে ‘এনার্জি অডিট’ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে কমিটি।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষের সব বৈদ্যুতিক বাতি ও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বন্ধ রেখে স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ওয়াসিকা আয়শা খানের সভাপতিত্বে কমিটির সদস্য নূরুল ইসলাম তালুকদার, খালেদা খানম ও নার্গিস রহমান বৈঠকে অংশ নেন।