নীল ভৌমিকের বাসায় কোনো দাবার বোর্ড ছিল না। কিন্তু ছিল দাবা খেলার খুব শখ। ঘরের ফ্লোরে চক দিয়ে দাবার বোর্ড আঁকত নীল। আর মাটি দিয়ে বানাত দাবার ঘুঁটি। এরপর সেই বোর্ডে স্কুলশিক্ষক বাবা হৃষিকেশ ভৌমিকের সঙ্গে দাবা খেলত। পড়া নষ্ট হবে ভেবে স্কুলশিক্ষিকা মা নীল আর তাঁর বাবার দাবা খেলা খুব একটা পছন্দ করতেন না। তাই শোবার চৌকির নিচে গিয়ে বাবা-ছেলে দাবা খেলতেন। দাবার প্রতি এই ভালোবাসার প্রতিদান পেয়েছে নীল। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া নীল ভৌমিক ময়মনসিংহ বিভাগের চ্যাম্পিয়ন স্কুল নেত্রকোনা জেলার আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নীলের জন্য গর্বিত বাবা হৃষিকেশ ভৌমিক বলেন, ‘দাবার বোর্ড কিনে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না আমাদের। কিন্তু দাবা খেলার প্রতি নীলের আগ্রহের কারণে কিছুতেই দমিয়ে রাখতে পারিনি নীলকে।’
এর আগেও স্কুল–দাবা প্রতিযোগিতায় নাম নিবন্ধন করে খেলতে পারেনি জয়ন্ত সরকার। কারণ, জয়ন্ত লম্বায় ছোট। খুব মন খারাপ করে বাসায় ফিরে আসে খুদে এই দাবাড়ু। তখন থেকেই জয়ন্তর মনের মধ্যে জেদ কাজ করে। দাবার বোর্ডের মাধ্যমেই জবাব দেবে উচ্চতায় ছোট বলে খেলতে না দেওয়ার বেদনার। অবশেষে সুযোগ হলো নেত্রকোনা জেলার আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী জয়ন্ত সরকার মাহীর। ‘মার্কস অ্যাকটিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’ প্রতিযোগিতায় শুধু নাম নিবন্ধন করেই বসে থাকেনি জয়ন্ত। দলগতভাবে তার স্কুলকে ময়মনসিংহ বিভাগের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন করিয়ে প্রমাণ দিয়েছে নিজের যোগ্যতার।
‘দাবা খেলতে হয় মাথা দিয়ে, শরীরের কাঠামো দিয়ে দাবা খেলা যায় না।’ এক নিমেষে ফোনের ওপ্রান্ত থেকে কথাগুলো বলে জয়ন্ত। ছোটবেলা থেকে দাবা ভালো খেলত। পরিবারের সবার একসঙ্গে দাবা খেলা দেখতে দেখতেই তার বেড়ে ওঠা। ‘আমার জন্মদিনে বড়দিদি একটি দাবার বোর্ড উপহার দিয়েছিলেন। খুব খুশি হয়েছিলাম। এখন পর্যন্ত ওটাই আমার জীবনের সেরা উপহার।’ ‘মার্কস অ্যাকটিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’ প্রতিযোগিতাকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে দাবার বোর্ডে নিজেকে বারবার প্রমাণ করতে চায় খুদে এই দাবাড়ু।
আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের দাবা–দলের অধিনায়ক ইশতিয়াক আহমেদ খানের দাবা–প্রতিভা পরিবার থেকেই। ইশতিয়াক জানান, ‘দাবা খেলার সঙ্গে পরিচয় করান আমার মা। প্রতিনিয়ত মায়ের সঙ্গে খেলে হেরে যাওয়া থেকে আমার দাবা খেলা শেখার আগ্রহ জন্মায়। মাকে একবার হারিয়ে দেওয়াই ছিল তখনকার একমাত্র লক্ষ্য। আস্তে আস্তে শিখতে থাকি দাবার খুঁটিনাটি নিয়ম। দাবা খেলার মানসিক লড়াইয়ের বিষয়টা আমাকে মুগ্ধ করে। অল্প সময়ের মধ্যে মাকে খেলায় হারিয়ে দিয়েও থেমে থাকিনি। চ্যাম্পিয়ন হয়েছি ময়মনসিংহ বিভাগে। এবার দেশ সেরা হওয়া লড়াই।’
দলের আরেক সদস্য নবম শ্রেণি পড়ুয়া ফাইয়াজ রহমানের দাবার কোনো উপকরণ ছিল না। স্কুল বা পাড়ার কাউকে দাবা খেলতে দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়ত ফাইয়াজ। দাবার সাদা-কালো ৩২টি ঘুঁটির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতেন। দাবার প্রতি এমন ভালোবাসা দেখেই ছোট খালা একটা পুরোনো দাবার বোর্ড উপহার দেন তাকে। এরপর আর ফাইয়াজকে কে পায়…। অবসর কাটানোর অন্যতম একটি মাধ্যম হয়ে যায় বুদ্ধিবৃত্তিক এই খেলাটি। ফাইয়াজ জানায়, ‘আমার বাবা-মা দাবা খেলা পছন্দ না করলেও আমাকে খেলতে বাধা দিতেন না। তবে শর্ত ছিল একটাই, পড়াশোনা যেন নষ্ট না হয়। এভাবে কয়েক বছর গেল দাবার চালগুলো আয়ত্তে আনতে। একদিন আমার দাবার শিক্ষক ছোট খালাকে হারিয়ে দিলাম। কী যে আনন্দ পেয়েছিলাম সেদিন।’ অসুস্থতার কারণে জেলা পর্যায়ে খেলায় অংশ নিতে পারেনি ফাইয়াজ রহমান। স্কুল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কারণে সুযোগ পায় বিভাগীয় পর্যায়ে অংশ নেওয়ার। সেখানেই বাজিমাত করে ফাইয়াজ। চ্যাম্পিয়ন হয় ফাইয়াজের স্কুল।
দলের আরেক সদস্য শ্রীজিৎ সরকার শ্রীয়মের গল্পটা একটু ভিন্ন। যে মানুষটি তাকে দাবা খেলায় সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিতেন, সেই মানুষটি হঠাৎ না–ফেরার দেশে চলে যান। দাবা খেলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে শ্রীজিৎ। মায়ের উৎসাহেই নাম লেখায় ‘মার্কস অ্যাকটিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’ প্রতিযোগিতায়। তবে শ্রীজিৎ সরকার শ্রীয়মের শুরুটা ছিল সুন্দর একটি গল্পের মতোই। ‘যখন আমার বয়স মাত্র সাত বছর, আমি প্রথম আমার একজন মামাকে দাবা খেলতে দেখি। খেলাটি দেখে আমার মনে খুবই আগ্রহ জন্মায়। তখনই আমি মামার কাছে খেলাটি শিখতে চাই।’ শ্রীজিৎ জানায়, ‘মামাও আমাকে আনন্দের সঙ্গে খেলাটি শিখিয়ে দেন৷ আমি নিয়মিত আমার মামার সঙ্গে চর্চা করতাম৷ পরিবারের পক্ষ থেকে আমি কখনোই বাধার সম্মুখীন হইনি৷ তবে বাবাই ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী ও কোচ।’ মা ও শিক্ষকদের উৎসাহে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ময়মনসিংহ বিভাগের চ্যাম্পিয়ন হয় শ্রীজিৎ সরকার শ্রীয়মের স্কুল। ‘এ সাফল্য বাবা দেখে যেতে পারলে অনেক খুশি হতেন…’ বলতে বলতেই গলা ভারী হয়ে ওঠে শ্রীয়মের।
‘মার্কস অ্যাকটিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’ ময়মনসিংহ বিভাগের চ্যাম্পিয়ন স্কুল আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের অন্য সদস্য হলো অনিরুদ্ধ গুণ।
বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের তত্ত্বাবধানে এবং আবুল খায়ের গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশজুড়ে চলছে ‘মার্কস অ্যাকটিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’ প্রতিযোগিতা। ‘হয়ে ওঠো আগামীর গ্র্যান্ডমাস্টার’ স্লোগানে প্রতিযোগিতাটি দেশের স্কুলভিত্তিক দাবার সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট। প্রতিযোগিতায় নিজ নিজ স্কুল বা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছে ৬৪টি জেলার শিক্ষার্থীরা। জেলা পর্যায়ে বিজয়ী স্কুলগুলো অংশ নিচ্ছে বিভাগীয় পর্যায়ে। বিভাগীয় পর্যায়ের সেরা দলগুলো অংশ নেবে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় অর্থাৎ চূড়ান্ত পর্যায়ে।