সারি সারি আসবাবের দোকান। বাতাসে কাঠের বার্নিশের ঝাঁজালো ঘ্রাণ। দোকানে দোকানে শোভা পাচ্ছে নকশা করা কাঠের চেয়ার, খাট, আলমারি, বুকশেলফ আর সোফা। কান পাতলে শোনা যায় কাঠের আসবাবে খোদাইয়ের ঠুক ঠুক শব্দ।
চট্টগ্রামের বাকলিয়ার বলিরহাটে কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে তিন বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা আসবাবপল্লিতে পা দিলে এমন চিত্র চোখে পড়বে। নগরের অন্যতম পুরোনো আসবাবের এই পল্লি এখন ঐতিহ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সস্তা ও টেকসই আসবাবের জন্য বলিরহাটের কদর যেমন আছে, তেমনি এখানকার আসবাবের সূক্ষ্ম কারুকাজেরও জুড়ি নেই। এখানকার ব্যবসায়ীদের মতে, বিয়ের উপহারের জন্য বনেদি পরিবারগুলো এখনো বলিরহাটের আসবাবের ওপরই ভরসা করে।
নগরের বহদ্দারহাট থেকে দুই কিলোমিটার দূরে নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা আসবাবের এই পল্লি প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দাবি করেন। তবে এখানকার ব্যবসা জমে উঠেছে মূলত ৫০ থেকে ৬০ বছর আগে। বলিরহাটের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী বাপ-দাদাদের হাত ধরে ব্যবসায় এসেছেন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আসবাবের নকশা ও ধরনের পরিবর্তন এলেও গুণগত মান ধরে রাখার চেষ্টা করেন তাঁরা।
এখানকার ছোট ছোট কারখানায় তৈরি আসবাব সরবরাহ করা হয় নগরের নামী শোরুমগুলোতে। এ ছাড়া ক্রেতারা নিজে এসে পছন্দের নকশায় বানিয়ে নেন আসবাব।
সম্প্রতি বলিরহাটে গিয়ে দেখা গেল প্রাত্যহিক কর্মব্যস্ততার চিত্র। কয়েক হাজার ছোট দোকান ও কারখানায় তৈরি হচ্ছে আসবাব। এই পল্লিতে শুধু কাঠের আসবাবেরই দেখা মিলল। দোকানিরা জানালেন, সেগুন, কড়ই, গর্জন ও গামারি কাঠের আসবাব তৈরি হলেও চাহিদা বেশি সেগুন কাঠের আসবাবের।
বলিরহাটের ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এখানে তিন হাজারের বেশি কারখানা ও বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। সকাল নয়টায় শুরু হয় আসবাব তৈরির কাজ। কাজ চলে রাত নয়টা পর্যন্ত। বছরে ১০০ কোটি থেকে ১৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও মহামারির কারণে গত কয়েক বছরে ব্যবসা কিছুটা কমেছে। বর্তমানে ৫০ হাজারের মতো শ্রমিক-কর্মচারী বলিরহাটের আসবাবশিল্পের সঙ্গে যুক্ত।
কথা হয় আসবাব ব্যবসায়ী মো. ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, পাঁচ ভাই মিলে একযুগ ধরে পৈতৃক ব্যবসা ধরে রেখেছেন তাঁরা। মূলত বিয়ের উপহারের জন্য বলিরহাটের আসবাবের ওপর নির্ভর করেন ক্রেতারা। নবদম্পতির সংসার সাজানো হয় বলিরহাটের আসবাবে। সেগুন কাঠের আসবাবের দাম বেশি হলেও চাহিদা বেশি। এ ছাড়া এই পল্লিতে সম্পূর্ণ ফিনিশিং বা তৈরি এবং ফিনিশিং ছাড়া—এই দুই ধরনের আসবাব বিক্রি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, নকশা ও মানভেদে সেগুন কাঠের খাট বিক্রি হয় ১৫ হাজার থেকে ২ লাখ টাকায়। ড্রেসিং টেবিল ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার এবং ডাইনিং টেবিল ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি শুরু হয়। চার হাজার থেকে পাওয়া যায় ডিভাইন। মধ্যবিত্তদের জন্য হাতের নাগালে রয়েছে গর্জন কিংবা গামারি কাঠের তৈরি আসবাব।
মুরাদপুর থেকে খাট কিনতে বলিরহাটে এসেছিলেন মো. ইরফান। তিনি বলেন, প্লাইউড কিংবা প্লাস্টিকের আসবাবের তুলনায় এখানে ব্যবহৃত কাঠ অধিক টেকসই। নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী নকশা করিয়ে নেওয়া যায়। এ জন্য অর্ডার দিয়ে খাট বানিয়ে নিতে এসেছেন তিনি।
করোনা মহামারি আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মন্দা কিছুটা প্রভাব ফেলেছে বলিরহাটের আসবাবের ব্যবসায়। তবে মন্দা কেটে গেলে আবার ঘুরে দাঁড়াবে ব্যবসা, এমন আশা এখানকার ব্যবসায়ীদের। আসবাব ব্যবসায়ী ইদ্রিস উদ্দিনও তেমনটাই মনে করেন।
তিনি বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে এই ব্যবসায় জড়িত তিনি। মাসিক আয়ের নির্দিষ্ট কোনো হিসাব থাকে না। কোনো মাসে এক লাখ, কোনো মাসে দুই লাখও আয় হয়। মহামারির কারণে ব্যবসায় কিছুটা লোকসান হয়েছিল। তবে সময়ের সঙ্গে চাহিদা বাড়ছে। তাই সামনের বছরে ব্যবসা আবার আগের মতো হবে বলে মনে করছেন।
তবে প্লাইউড, প্লাস্টিক ও রট আয়রনের কারণে কাঠের আসবাবের চাহিদা কিছুটা কমেছে বলে মনে করেন বলিরহাট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মজিবুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, প্লাইউডের ব্যবহারের কারণে প্রাকৃতিক কাঠের আসবাবের চাহিদা কমেছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক মন্দার কারণেও ব্যবসা কমেছে। কিন্তু বিয়ের জন্য এখনো মানুষ বলিরহাটের আসবাবের ওপরই নির্ভর করে। এটাই বড় আশার কথা।