গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন আইনবিদেরা। তাঁরা বলেছেন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারের জন্য এখন যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রয়েছে, সেখানেও গুমের ঘটনার বিচার করা যায়। কিন্তু ওই ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যার অভিযোগ জমা পড়েছে। তাই গুমের বিচারের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা ঘটতে পারে। এ কারণে দ্রুত বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা দরকার।
‘জোরপূর্বক গুম-খুনের বিচারপ্রক্রিয়া সংকট ও সমাধান’ শীর্ষক আলোচনায় আইনবিদেরা এই অভিমত দিয়েছেন। গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ গতকাল শুক্রবার বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনী কক্ষে এই আলোচনার আয়োজন করে।
ইতিহাসের এই ঘৃণ্য ঘটনার যদি বিচার করা না হয়, তবে চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধের বিচার করা অর্থহীন হয়ে পড়ে।মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আলোচনা পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, বিগত বছরগুলোতে দেশে যেভাবে গুমের ঘটনা ঘটেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাড়া এর চেয়ে বড় অপরাধ আর ঘটেনি। ইতিহাসের এই ঘৃণ্য ঘটনার যদি বিচার করা না হয়, তবে চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধের বিচার করা অর্থহীন হয়ে পড়ে। এখন এই অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, গুম-খুনের বিচার প্রচলিত আইনে, সেনা আইনে, নতুন আইন করে এবং আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে—এই চারভাবে করা সম্ভব। তবে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যেন না ঘটে, সে জন্য নতুন আইন করে বিচার করা দরকার। দ্রুত বিচার করার জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা জরুরি।
মাহবুবুর রহমান বলেন, কোনো নাগরিককে গ্রেপ্তার করার আইনগত অধিকার বাংলাদেশের কোনো গোয়েন্দা সংস্থার নেই। কারণ, এই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রশাসনিক আদেশ দ্বারা গঠন করা হয়েছে, আইনগতভাবে করা হয়নি। সে কারণে গোয়েন্দা সংস্থার করা গ্রেপ্তার—যাকে ‘গুম’ বলা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ বেআইনি। এ ছাড়া আইন অনুসারে থানা বা জেলখানা ছাড়া কোথাও গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিকে রাখা যায় না। ফলে কোনো সংস্থার যে ‘আয়নাঘর’ বা আটক রাখার গোপন কক্ষ, সেগুলোও সম্পূর্ণ আইনবিরোধী। এসবের বিচার হওয়া প্রয়োজন।
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘আমাদের দণ্ডবিধিতে গুমের জন্য স্পষ্ট আইন নেই, অপহরণের জন্য আইন আছে। গুম আর অপহরণ এক নয়। গুম অনেক ভয়ংকর গুরুতর অপরাধ। এর জন্য গুরুতর সাজা হওয়া বাঞ্ছনীয়। সে কারণে গুমের জন্য নতুন আইন প্রয়োজন।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এড়াতে আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন তিনি। পাশাপাশি গুমের ঘটনার বিচারের জন্য সব তথ্য–প্রমাণ সংরক্ষণের দাবি জানান এই আইনজীবী।
আইনবিদ ও হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিনথিয়া ফরিদ বলেন, গুম অত্যন্ত ঘৃণ্য অপরাধ। প্রমাণ হিসেবে কোনো কাগজপত্র না থাকলেও গুমের শিকার ব্যক্তিদের বয়ান ও বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষ্য থেকে এই অপরাধের বিচার করা সম্ভব। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমন বিচার ও কঠিন সাজার দৃষ্টান্ত রয়েছে।
প্যানেল আলোচনার পর শ্রোতা ও গুমের শিকার পরিবারের সদস্যরা প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন।
আলোচনার সঞ্চালক মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান বলেন, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যে ২৩টি ‘আয়নাঘরের’ সন্ধান পাওয়া গেছে, সেখানে সব প্রমাণ সংরক্ষণ করতে হবে। এ বিষয়ে যাবতীয় তথ্য জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে হবে। তিনি জানান, ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সূত্রে ৭০৯ জন ব্যক্তির গুমের ঘটনা জানা গেছে। এর মধ্যে ১৫৫ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছে। তাদের উদ্ধারসহ দ্রুত গুমের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
মায়ের ডাকের আয়োজনে গত ৩০ আগস্ট থেকে নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনী কক্ষে আলোকচিত্রী মোশফিকুর রহমানের ‘গুম: জান ও জবান’ শীর্ষক একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী চলছে।
মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রদর্শনী উপলক্ষে তাঁরা গুম-খুনের বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে বিষয়ভিত্তিক ধারাবাহিক আলোচনার আয়োজন করেছেন। এর আওতায় গতকাল বিচারপ্রক্রিয়ার সংকট ও সমাধান নিয়ে আলোচনা হয়।
আলোকচিত্র প্রদর্শনী চলবে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।