অস্ত্রোপচার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি বাড়ানো দরকার।
সন্তান প্রসবে দেশে অস্ত্রোপচার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ১০০ প্রসবে ৪৫টি শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। মোট সংখ্যার হিসাবে দেশে প্রতিবছর ১৬ লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে এভাবে। এর মধ্যে ১০ লাখের বেশি শিশুর জন্মে হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে।
অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের এই পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে (২০২২)। জরিপে আরও বলা হয়েছে, জাতীয়ভাবে মোট প্রজনন হার (টিএফআর) প্রায় এক দশক ধরে স্থির হয়ে আছে, সরকার তা
কমাতে পারছে না। বরং কোনো কোনো বিভাগে টিএফআর বাড়তে দেখা গেছে। তবে স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতির চিত্রও এই জরিপে উঠে এসেছে। শিশুমৃত্যু হার কমেছে, আগের চেয়ে বেশি প্রসব হচ্ছে হাসপাতালে।
পাঁচতারা হোটেলে এই জাতীয় জরিপের প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট)। এই আয়োজনে সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)।
১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশে জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ হয়ে আসছে। প্রতি তিন বা চার বছর পরপর এই জরিপ হয়ে থাকে। জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের তথ্যকে স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, দেশি–বিদেশি গবেষকেরা, বিজ্ঞানীরা, সাংবাদিকেরা এই জরিপের পরিসংখ্যানকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করে আসছেন।
সর্বশেষ এই জরিপে দেশের সব বিভাগের গ্রাম ও শহরের ৩০ হাজার ১৮টি খানার তথ্য নেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালের ২৭ জুন থেকে ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই প্রথমবার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে।
গতকালের অনুষ্ঠানের শুরুতে নিপোর্টের পরিচালক (গবেষণা) মোহাম্মদ আহসানুল আলম বলেন, সামাজিক ও জনমিতিক চরিত্র, নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এবং অত্যাবশ্যকীয় সেবার আওতা কতটা বিস্তৃত, তা জানা–বোঝার জন্য এই জরিপ করা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি ১০০ গর্ভধারণে ১০ থেকে ১৫ জন মায়ের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। তখন প্রসবে জটিলতার আশঙ্কা দেখা দেয়। এসব ক্ষেত্রে মা ও সন্তানের জীবন রক্ষায় প্রসবের সময় অস্ত্রোপচার করতে হয়। এটি একটি জীবনরক্ষাকারী ব্যবস্থা। ১৫ শতাংশের বেশি অস্ত্রোপচার হলে তা অপ্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা প্রায় দুই দশক ধরে বলে আসছেন, দেশে সন্তান জন্মদানে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বাড়ছে।
উপস্থাপনায় বলা হয়, বছরে প্রায় ৩৬ লাখ শিশুর জন্ম হয়। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ বা ১৬ লাখের কিছু বেশি শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ বা ১০ লাখ ৮০ হাজার শিশুর জন্মে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার হচ্ছে।
তবে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের বড় অংশটি হচ্ছে বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে। শিশু জন্মে যত অস্ত্রোপচার হচ্ছে, তার ৮৪ শতাংশ হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। সরকারি হাসপাতালে হচ্ছে ১৪ শতাংশ। বাকি ২ শতাংশ হচ্ছে এনজিও পরিচালিত কিছু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
জরিপের এই অংশ উপস্থাপনার সময় আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, ‘প্রসবে এই বিপুলসংখ্যক অস্ত্রোপচারের কথা জানতে পেরে আমরা আশ্চর্য হয়েছি, স্তম্ভিত হয়ে গেছি। এটা কিছুতেই যৌক্তিক না। আমাদের অবশ্যই অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার ঠেকাতে হবে।’
অস্ত্রোপচারের কারণে প্রসবের পর অনেক ক্ষেত্রে মায়ের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। অস্ত্রোপচারের কারণে সংক্রমণ দেখা দেয়। এ ছাড়া এই ধরনের প্রসবে খরচ অনেক বেশি।
গতকালের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল। অনুষ্ঠানের পর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন আর কোভিডের দোষ দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। এই বাস্তবতা মানতে হবে যে সরকারের কর্মসূচি ঠিকমতো চলছে না, নজরদারির ঘাটতি আছে। আত্মশুদ্ধির পথে না গেলে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। জনসংখ্যাকে একসময় দেশের ১ নম্বর সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বাংলাদেশে জনসংখ্যা খাতে সাফল্য অর্জন করেছিল মূলত মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা টিএফআর) কমানোর মাধ্যমে। স্বাধীনতার পরপর টিএফআর ছিল ৬। অর্থাৎ একজন ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারী গড়ে ছয়টি সন্তানের জন্ম দিতেন। নানা উদ্যোগের কারণে টিএফআর কমতে থাকে। ক্রমাগতভাবে টিএফআর কমিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
সর্বশেষ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ বলছে, গত এক দশক ধরে টিএফআর ২ দশমিক ৩–এ স্থির হয়ে আছে। অর্থাৎ প্রজননক্ষম একজন নারী গড়ে দুটির বেশি সন্তান জন্ম দিচ্ছেন।
২০১১ সালের জরিপে টিএফআর ছিল ২ দশমিক ৩। পরের তিনটি জরিপেও একই চিত্র দেখা গেছে।
যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে টিএফআর না কমে উল্টো বাড়তে দেখা গেছে। সর্বশেষ জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, একাধিক বিভাগে টিএফআর বেড়েছে। এই তালিকায় আছে বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ ও রংপুর বিভাগ। ঢাকা বিভাগে টিএফআর আগে ছিল ২ দশমিক ২। এখনো তাই। টিএফআর কমেছে রাজশাহী ও সিলেট বিভাগে। দেশে টিএফআর এখন সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহ বিভাগে, ২ দশমিক ৭। অর্থাৎ এই বিভাগে একজন মা গড়ে প্রায় তিনটি শিশুর জন্ম দিয়ে চলেছেন। অন্যদিকে খুলনা বিভাগে টিএফআর ছিল ১ দশমিক ৯। এই ধরনের টিএফআর দেখা যায় সাধারণত ইউরোপের দেশগুলোতে। কিন্তু সর্বশেষ জরিপ বলছে, খুলনা বিভাগের টিএফআর ২ দশমিক ২।
জরিপ বলছে, বাংলাদেশে খর্বকায় শিশুর হার কমছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৪ শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। আগের তিনটি জরিপের তথ্যের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, দেশে খর্বকায় শিশুর হার ক্রমাগত কমছে। ২০১১ ও ২০১৪ সালে বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম শিশুর হার ছিল যথাক্রমে ৪১ ও ৩৬ শতাংশ। ২০১৭–১৮ সালের জরিপে দেখা যায় সেই হার কমে ৩১ শতাংশ হয়েছে।
শিশুপুষ্টির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দেশে কম ওজনের শিশুর হার কমছে না। বর্তমানে পাঁচ বছরের কম বয়সী কম ওজনের শিশুর হার ২২ শতাংশ। ২০১৭–১৮ সালেও এই হার ছিল ২২ শতাংশ। অন্যদিকে কৃষকায় শিশুর হার বাড়ছে। ২০১৭–১৮ সালে কৃষকায় শিশু ছিল ৮ শতাংশ। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১১ শতাংশ। এটি পুষ্টি পরিস্থিতির অবনতির লক্ষণ।
শিশুর পুষ্টি নির্ভর করে মায়ের দুধ খাওয়ানো ও প্রয়োজনীয় শিশুখাদ্য খাওয়ানোর ওপর। শিশুপুষ্টির অংশটুকু উপস্থাপনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নলেজ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ সুস্মিতা খান বলেন, বুকের দুধ খাওয়ানো ৬ মাসের কম বয়সী শিশুদের হার কমেছে। ৪ বছর আগে ৬৫ শতাংশ শিশু ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ খেত, সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে তা কমে ৫৫ শতাংশ হয়েছে। তিনি বলেন, জরিপের আগের দিন ৬–২৩ মাস বয়সী ৪৯ শতাংশ শিশু অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়েছিল বলে জরিপের তথ্যে উঠে এসেছে।
দেশে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। জরিপ বলছে, এক হাজার শিশুর জন্ম হলে তাদের বয়স ৫ বছর হওয়ার আগেই ৩১টি শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। ৪ বছর আগে তা ছিল ৪৩। জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে আগে ২৭টি (এক হাজারের মধ্যে) নবজাতকের মৃত্যু হতো, এখন তা ২০। এটাকে সরকারি কর্মকর্তারা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলে দাবি করেছেন।
৪ বছর আগে ৫১ শতাংশ প্রসব কোনো না কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হতে দেখা গিয়েছিল। এখন তা ৬৫ শতাংশ। আর ৭০ শতাংশ প্রসব হচ্ছে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তায়। ৪ বছর আগে তা ছিল ৫৪ শতাংশ।
এই জরিপে দেশে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস পরিস্থিতির তথ্যও সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে সেই তথ্য গতকালের অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করা হয়নি। জরিপের অন্যান্য তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন ইউএসএআইডির টিম লিড (ফ্যামিলি হেলথ) উম্মে সালমা জাহান ও আইসিডিডিআরবির সহকারী বিজ্ঞানী এম মইনউদ্দীন হায়দার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নিপোর্টের মহাপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম।