রাঙামাটির দুর্গম পাহাড় পেরিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে শিশুরা। সম্প্রতি সদর উপজেলার তৈমিদুং থেকে তোলা
রাঙামাটির দুর্গম পাহাড় পেরিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে শিশুরা। সম্প্রতি সদর উপজেলার তৈমিদুং থেকে তোলা

দেশের সব ভাষা রক্ষা করতে হবে

ভাষা হচ্ছে সভ্যতার সম্পদ। আমাদের আত্মপরিচয় ও সংস্কৃতির বাহন। মানুষ যদি ভাষার মাধ্যমে তার চিন্তাভাবনা-তথ্য আদান-প্রদান করতে না পারত, তাহলে একদিকে যেমন সমাজ-রাষ্ট্র বা সভ্যতার উন্নতি ঘটত না, তেমনি জাতি-বৈচিত্র্যের এই বিশ্বে অন্য সংস্কৃতি সম্পর্কে জানাও সম্ভব হতো না। বাংলাদেশ একটি বহু জাতি, বহু ভাষা এবং বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ রাষ্ট্র। আমাদের জাতীয় ও দাপ্তরিক ভাষা বাংলা হলেও শতকরা দুই ভাগ বা তার কাছাকাছি ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ এ দেশে বাস করে। আমাদের দেশে প্রায় ৩০ লাখ বা তারও বেশি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বা আদিবাসী মানুষ বসবাস করে। এদের মধ্যে উর্দুভাষী, বিহারি, অহমিয়া, তেলেগুসহ আরও কিছু পেশার মানুষ বাস করে, যাদের ভাষা বাংলা থেকে ভিন্ন। গবেষণার তথ্য অনুসারে, এ দেশে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী ছাড়াও কমপক্ষে ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। এদের সবারই রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। আর বাংলাদেশের সঙ্গে এই ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাস জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের বৈচিত্র্যের ঐকতানকে করেছে সমৃদ্ধ।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের মধ্যে প্রায় ৪০টি পৃথক বৈশিষ্ট্যের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা প্রচলিত আছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সাঁওতাল, চাকমা, গারো (মান্দি), ত্রিপুরা (ককবরক), সাদরি, খেয়াং, খুমি, লুসাই, মুন্ডা, মণিপুরি (মেইতেই ও বিষ্ণুপ্রিয়া), ম্রো, পাংখোয়া, হাজং, পাত্র, খাস কোল, কোডা, সৌরা প্রভৃতি। এই ভাষাগুলো পৃথিবীর প্রধান চারটি ভাষা-পরিবারের (অস্ট্রো-এশিয়াটিক, তিব্বতি-চীন, দ্রাবিড় ও ইন্দো-ইউরোপীয়) সদস্য। ভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভাষার স্বকীয়তা দেশের সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। আমরা জানি, বাংলাদেশে বা বাংলাভাষী অঞ্চলে একেক এলাকায় বাংলা ভাষার উপভাষিক বৈচিত্র্য রয়েছে৷ যেমন সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, চট্টগ্রাম বা নোয়াখালীতে একই বাংলা ভাষা, কিন্তু তাঁরা ভিন্নভাবে কথা বলেন। তাঁদের ভাষায় ধ্বনিতাত্ত্বিক এবং শব্দভান্ডারের পার্থক্য রয়েছে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। চারটি ভাষা পরিবারের মধ্যে কয়েকটি ভাষা পরস্পর এতটাই ঘনিষ্ঠ যে সেগুলোকে উপভাষিক বৈচিত্র্য বলা যায়। ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় অবস্থান করার কারণেও এদের মধ্যে উপভাষিক বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। তবে বাংলাদেশের এসব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জাতির মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ভাষার নিজস্ব লিপি রয়েছে। যেমন চাকমা, মারমা, রাখাইন, মেইতেই মণিপুরি, ম্রো। গারো, খাসি, বম, খুমি, পাংখোয়া, লুসাই, ককবরক, সাঁওতাল (আংশিক) ইত্যাদি ভাষা লেখা হয় আত্তীকৃত রোমান বর্ণমালায়। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, কোল, হাজং, সাঁওতাল (আংশিক), মুন্ডা, সাদরিসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভাষা লেখার জন্য ব্যবহার করা হয় বাংলা বর্ণমালা। চাক ও ম্রোরা তাদের নিজেদের উদ্ভাবিত লিপি দিয়ে পাঠদান শুরু করেছে সীমিত পরিসরে।

ভাষাগত বৈচিত্র্যের সযত্ন লালন ও সুরক্ষার ওপর জোর দিতে হবে, যাতে ভাষার কারণে কোনো বিরোধ ও বৈষম্যের সৃষ্টি না হয়। মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন, বিকাশ, চর্চা, প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ধরে রাখাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কারণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে আন্তসাংস্কৃতিক আদান-প্রদানে ভাষার বৈচিত্র্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ দুর্ভাগ্যবশত তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আমাদের বাংলা ভাষার পাশাপাশি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় শিক্ষার সুযোগ না থাকায় প্রচলিত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে তাদের বাংলাকে গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। এতে নিজের ভাষা তাদের কাছে গুরুত্ব হারাচ্ছে। তা ছাড়া নতুন প্রজন্মের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সন্তানেরা বাস্তবতার তাগিদে নিজের ভাষার চেয়ে বাংলা অথবা ইংরেজির চর্চাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। ফলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় সংখ্যাগুরু তথা বাঙালিদের ভাষার ব্যাপক প্রভাবের কারণে তাদের নিজস্ব ভাষা ক্রমে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার
কথা বলা হয়েছিল। সরকার ২০১৩ সালে বিষয়টি বাস্তবায়নের উদ্যোগও নিয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর পাঁচটি ভাষায় (চাকমা, গারো, মারমা, সাদরি ও ত্রিপুরা) শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত ও পাঠদান শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠদান করা হবে তাঁরা স্থির করেছিলেন। সাঁওতালরা তাঁদের বর্ণমালার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাতে না পারায় শেষ পর্যন্ত তাঁদের ভাষায় শিখন উপকরণ প্রণয়ন প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, এটিকে ফলপ্রসূ বা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্য থেকে শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণসহ বহু কাজ নানা জটিলতায়
আটকে আছে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সমীক্ষা অনুসারে, দেশের ১৪টি ভাষা বিপন্নতার সীমায় অবস্থান করছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কোল, কোডা, সৌরা, খুমি, পাংখো, খেয়াং, রেংমিটচা। যেমন ২০১৩ সালেও আলি কদমে কয়েকটি পাড়ায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ২২ জন রেংমিটচা ভাষাভাষীর লোক পাওয়া গিয়েছিল। অথচ ১১ বছরের ব্যবধানে ২০২৪ সালে এসে সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয়জনে। বাকিরা মারা গেছেন। এই ভাষা রক্ষার উদ্যোগ না নিলে আমাদের দেশের একটি ভাষিক বৈচিত্র্য হারিয়ে যাবে অল্পদিনেই।

আমরা জানি, একটি ভাষা আমাদের সমাজের সাংস্কৃতিক ও প্রথাগত জ্ঞানবৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ক্রমে ক্রমে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষাগুলো যদি হারিয়ে যায়, তাহলে সেই ভাষার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, স্মৃতি, সম্পদ ও অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যতাকেও আমরা হারিয়ে ফেলব।

ভাষার বিপন্নতা প্রতিরোধে গবেষক এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলো মাতৃভাষা বা প্রধান ভাষার ওপর ভিত্তি করে বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাকে উৎসাহিত করে। ফলে আমাদের উচিত সব ভাষার জন্য মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষী শিক্ষা কর্মসূচি প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করা।

পরিবর্তনশীল বিশ্বে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষাগুলোয় প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে। একদিকে তাদের ভাষায় সমকালীন বাংলা শব্দ ঢুকে যাচ্ছে, অন্যদিকে নিজস্ব লিপির অভাবে মাতৃভাষায় লিখিত সাহিত্য অত্যন্ত সীমিত হয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে লোককথা বা লোকজ্ঞানমূলক সাহিত্য। আবার অনেকেরই নিজস্ব লিপি থাকলেও তারা সে লিপি চর্চা করছে না, বরং বেশির ভাগ সাহিত্যই রচনা করছে বাংলা হরফে। এ ছাড়া বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাহিত্য-সংকলন, ধর্মীয় গুণকীর্তনমূলক গান-কবিতা প্রভৃতি রচিত হচ্ছে রোমান অক্ষরে। ফলে এভাবে চলতে থাকলে বর্তমান পৃথিবীর ভাষিক বৈচিত্র্যের অসাধারণ নিদর্শন এসব ভাষা হয়তো অচিরেই মুছে যাবে মানবসভ্যতার ইতিহাস থেকে। তাই বৈচিত্র্যময় এসব জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজন তাদের ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ও সংরক্ষণ।

আবার এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না যে কোনো ভাষাই সংরক্ষণ করে টিকিয়ে রাখা যায় না। ভাষার ব্যবহারের জায়গা সম্প্রসারণ করতে হয়। আর্কাইভে ব্যাকরণ বা অভিধান সংরক্ষণ করা যেতে পারে, তাতে ভাষা টিকবে না। ভাষা টেকাতে হলে সব ভাষার নতুন প্রজন্মকে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, বিনোদনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেই ভাষাচর্চার সুযোগ করে দিতে হবে। যাঁদের হরফ নেই, তাঁদের হরফের ব্যবস্থা করতে হবে। আর এ জন্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে যেমন এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি রাষ্ট্রের দায়িত্বও অনেক।

এ দেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর যে ভাষাবৈচিত্র্য রয়েছে, তা তাদের ও দেশের সম্পদ। কিন্তু কিছু কিছু ভাষা এরই মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে। তাই আর কালক্ষেপণ না করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ভাষানীতি নির্ধারণ এবং সেই সঙ্গে ভাষা-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নই পারে সেগুলো টিকিয়ে রাখতে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও এখন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের অস্তিত্ব ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য বেশি উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশ জাতিসংঘের ‘সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ’ ছাড়া ১২টি আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছে, যেখানে আদিবাসীদের মানবাধিকারের কথা বলা হয়েছে।

সভ্যতার মানচিত্রে স্থান পেতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই তাঁদের বিশেষ অধিকার ও মর্যাদার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের পাশাপাশি তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা ও বিকাশের উদ্যোগ নিতে হবে। তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে। এ দেশের মানুষ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। এখন বিশ্বের ভাষাগত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে কেন্দ্র করে সব ভাষার সংরক্ষণ ও সুরক্ষার লক্ষ্যে দিনটি আমরা পালন করি। তাই বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষার সুরক্ষা ও ভাষার প্রতি সম্মান প্রদানের গুরুত্বকে অনুধাবন করা প্রয়োজন।

এ ছাড়া ভাষাগত বৈচিত্র্যের সযত্ন লালন ও সুরক্ষার ওপর জোর দিতে হবে, যাতে ভাষার কারণে কোনো বিরোধ ও বৈষম্যের সৃষ্টি না হয়। মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন, বিকাশ, চর্চা, প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ধরে রাখাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কারণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে আন্তসাংস্কৃতিক আদান-প্রদানে ভাষার বৈচিত্র্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের ভাষা-সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে দ্রুত একটি ভাষানীতি তৈরি করা এবং তা কার্যকরের মধ্য দিয়ে বৈচিত্র্যময় এসব ভাষাকে যথাযথ সম্পদে পরিণত করা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য একটি অবশ্য কর্তব্য।

  • লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।