বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার আন্দোলনে গণহত্যা চালানোর অভিযোগের প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আইনগতভাবেই দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভবনের সামনে আজ রোববার দুপুরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে চিফ প্রসিকিউটর এ কথা বলেন। এ সময় প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম ও বি এম সুলতান মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন।
পৃথক ঘটনায় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত ১৪ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় ১১টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের যেসব অভিযোগ এসেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তিনি ইতিমধ্যে দেশের বাইরে এবং তাঁকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কোনো বার্তা আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘সম্ভাব্য প্রধান অপরাধী তিনি দেশ থেকে পালিয়েছেন, তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আইনি প্রক্রিয়া, সেটা আমরা শুরু করব। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অপরাধী প্রত্যর্পণ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে ২০১৩ সালে। শেখ হাসিনা সরকার তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁর সময়ে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তিনি যেহেতু বাংলাদেশের গণহত্যার প্রধান আসামি হবেন বলে আমরা মনে করছি বা অধিকাংশ মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে, সুতরাং এ প্রক্রিয়া শুরুর মাধ্যমে তাঁকে আইনগতভাবেই বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করব।’
নিজের চ্যালেঞ্জ কী মনে করছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে এভিডেন্স (তথ্য–প্রমাণ) সংগ্রহ করা। অপরাধটা গোটা বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রায় সব জায়গায় সংঘটিত হয়েছে একই সাথে। প্রতিটি জায়গায় একটা কমন ইনস্ট্রাকশন ছিল যে গুলি করে সব মেরে ফেলো।…এই অপরাধের যে আলামতগুলো সংগ্রহ করা, সেগুলো কম্পাইল করা—এটা একটা চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আসামিরা এখনো সবাই পলাতক এবং প্রধান আসামিগণ অনেকেই দেশত্যাগ করেছেন, দেশত্যাগের চেষ্টায় আছেন। তাঁদের আইনের আওতায় নিয়ে আসাটা একটা প্রধান চ্যালেঞ্জ। আর আলামতগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে নষ্ট হওয়ার আগে সংরক্ষণ করা—এই দুটো চ্যালেঞ্জ মনে করি।’
ব্রিফিংয়ে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের প্রথম প্রায়োরিটি হচ্ছে, যেহেতু এ ঘটনাগুলো খুবই তাজা, এই এভিডেন্সগুলো যাঁরা অপরাধী আছেন, যাঁরা আসামি হবেন এই মামলাগুলোতে, তাঁরা কিন্তু এখনো বাংলাদেশে বিভিন্ন জায়গায় আছেন। অনেকে দায়িত্বেও আছেন। তাঁরা এ আলামতগুলো ধ্বংস করার চেষ্টা করবেন। প্রথম প্রায়োরিটি হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ড–গণহত্যার যে আলামত আছে, সেগুলো সংরক্ষণ করা। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এগুলো সংগ্রহ করে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার হাতে নিয়ে আসা। যাতে ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে এই আলামতগুলো আদালতের সামনে উপস্থাপন করতে পারি।’ সব ধরনের আলামত ও তথ্য–প্রমাণ দ্রুততম সময়ে এই ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম কিংবা তদন্ত সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য ছাত্র-জনতাসহ ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘জানেন যে একটি রাষ্ট্রে যখন গণহত্যার মাধ্যমে একটা স্বৈরশাসনের পতন হয়, ইতিহাসের পটপরিবর্তন হয়, তারপরে শহীদ ও নির্যাতিত যেসব মানুষ, তাঁরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে যান। এই প্রতিশোধপরায়ণতার আগুন নেভানোর সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে উত্তম পন্থা হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রদান করা। যাঁরা এই অপকর্ম ও অন্যায়গুলো করেছেন, যদি সঠিক বিচারের মাধ্যমে তাঁদের সাজা দেওয়া যায়, তাহলে মানুষ প্রতিশোধপ্রবণতা থেকে ফিরে আসে। বাংলাদেশের সমাজ যাতে বিভাজিত হয়ে না যায়, সে জন্য যাঁরা ঠান্ডা মাথায় আমাদের নিরস্ত্র সন্তানদের হত্যা করেছেন, তাঁদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।’
চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, ‘এটা আমাদের প্রায়োরিটি এবং এই প্রায়োরিটির অংশ হিসেবে আমরা চাইব, দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হবে। এখানে ন্যায়পরায়ণ, সৎ ও সাহসী বিচারকদের নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থায় যোগ্য মানুষেরা আসবেন এবং আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে এখানে সুষ্ঠু বিচার চাইব। এটা এমন একটা বিচার হবে, বিচারের পরে শহীদ পরিবার, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, বাদীপক্ষসহ আসামিপক্ষও মনে করবে, তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা হয়েছে।...এই আবহ নিশ্চিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করব।…দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই ট্রাইব্যুনাল সক্রিয় করে এ জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার চেষ্টা আমাদের থাকবে।’
তদন্ত পর্যায়ে আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এই অপরাধগুলোর মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে তদন্তকালে আসামিদের গ্রেপ্তার করার প্রয়োজন হবে। নিশ্চয়ই আমরা এই অপরাধীদের গ্রেপ্তার চাইব।…আমাদের প্রথম চেষ্টা থাকবে, সম্ভাব্য অপরাধী বা আসামি যাঁরা আছেন, তাঁরা যাতে আদালতের জুরিসডিকশনের বাইরে চলে যেতে না পারেন, দেশত্যাগ না করতে পারেন—সেটা ঠেকানোর সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে।’
তদন্ত সংস্থায় দায়ের হওয়া অভিযোগুলোর প্রতিটিতে প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী, তাঁর ব্যাপারে কী—এমন প্রশ্নে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কে কত বড় আসামি, কে কত বড় পদে ছিলেন, আইন সেটা দেখবে না। আইনের চোখে সবাই সমান। যিনি অপরাধ করেছেন, অপরাধের গুরুত্ব হিসেবে আসামির সঙ্গে ডিল করা হবে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী হোক, আইজিপি হোক বা যত বড় ক্ষমতাধর মন্ত্রীই হোক, তাঁরা যখন অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন, আসামি হিসেবে দাঁড়াবেন, প্রত্যেকেই সমান আচরণ পাবেন। তাঁদের প্রতি কোনো জুলুমও করা হবে না, তাঁদের কোনো ছাড়ও দেওয়া হবে না।’
ট্রাইব্যুনালের আইন সংস্কারের প্রয়োজন আছে কি না—এমন প্রশ্নে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা মাত্রই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আমরা সরকারের সঙ্গে বসে এগুলো নিয়ে আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেব।’
এর আগে ৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনার জন্য প্রসিকিউটর নিয়োগের কথা জানিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ তাজুল ইসলামকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর নিয়োগ পাওয়া চার আইনজীবী হলেন মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম (গাজী এম এইচ তামিম), বি এম সুলতান মাহমুদ ও আবদুল্লাহ আল নোমান।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার পর গত ১৪ বছরে ট্রাইব্যুনাল ৫৫টি মামলায় রায় দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে বেশ কয়েকজনের দণ্ডও কার্যকর হয়েছে।
গণ–অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। এরপর দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান তিনি। গত ১৪ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পৃথক ১১টি অভিযোগ তদন্ত সংস্থায় দায়ের করা হয়েছে। এসব অভিযোগের মধ্যে ১০টি ছাত্র–জনতার আন্দোলনের সময় নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে। অপরটি হচ্ছে ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি ঘিরে গণহত্যার অভিযোগ।