গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগিসহ সব ধরনের মাংসের উৎপাদনই কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা
গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগিসহ সব ধরনের মাংসের উৎপাদনই কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা

৯ বছর পর কমল মাংসের উৎপাদন

  • গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগিসহ সব ধরনের মাংসের উৎপাদনই কিছুটা কমেছে।

  • উৎপাদন বৃদ্ধির সর্বশেষ বছর (২০২১-২২) উৎপাদন ছিল ৯২ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। 

  • এই উৎপাদন কমে গত বছর (২০২২-২৩) দাঁড়ায় ৮৭ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন।

টানা ৯ বছর বৃদ্ধি পাওয়ার পর দেশে প্রথমবারের মতো মাংসের উৎপাদন কমেছে। আগেরবারের তুলনায় গত অর্থবছর (২০২২–২৩) ৫ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কম মাংস উৎপাদন হয়েছে। এতে দিনে জনপ্রতি মাংসের প্রাপ্যতা কমেছে ১০ গ্রামের বেশি।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে গত ১০ বছরে (২০১৩–১৪ থেকে ২০২২–২৩) মাংস উৎপাদনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। 

দেশে ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে প্রতিবছর মাংসের উৎপাদন বাড়ছিল। গত অর্থবছরই প্রথম (২০২২–২৩) উৎপাদন কমেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩–১৪ অর্থবছর থেকে দেশে প্রতিবছর মাংসের উৎপাদন বাড়ছিল। গত অর্থবছরই প্রথম উৎপাদন কমেছে। উৎপাদন কমার আগের বছর (২০২১–২২) মাংসের উৎপাদন ছিল ৯২ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। তবে গত বছর তা কমে দাঁড়ায় ৮৭ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টনে।

গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগিসহ সব ধরনের মাংসের উৎপাদনই কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

সংখ্যা বেড়েছে, তবে উৎপাদন কমেছে 

২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগিসহ অন্যান্য প্রাণিসম্পদের সংখ্যা বাড়ছে। মাংসের উৎপাদন কমার বছর অর্থাৎ গত অর্থবছরও গবাদিপশুর সংখ্যা বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে গবাদিপশু ও পোলট্রির সংখ্যা ছিল ৪৩ কোটি ২৩ লাখ ৭৯ হাজার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ কোটি ২৮ লাখ ৪৭ হাজারে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাণিসম্পদের সংখ্যা বাড়লে উৎপাদন কমার কথা নয়। মূলত প্রাণিসম্পদের দেওয়া হিসাবের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় হাতে গোনা কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে অন্য কাজের পাশাপাশি তাঁদের পক্ষে সেখানকার প্রাণিসম্পদের প্রকৃত চিত্র তুলে আনা কঠিন। তবে প্রাণিসম্পদের তথ্যে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি থাকলেও মানুষের পাতে যথেষ্ট মাংস পড়ছে না বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

কোরবানির পশুর বড় একটি অংশ অবিক্রীত থাকায় গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ করা খামারিদের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতেও কিছুটা উৎপাদন কমেছে। 
মোহাম্মদ রেয়াজুল, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন)

উৎপাদন কমল কেন

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, প্রধানত তিনটি কারণে উৎপাদন কমেছে। প্রথমত, করোনার পর থেকে পোলট্রি ও গোখাদ্যের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, কয়েক বছর ধরে প্রচুর কোরবানির পশু অবিক্রীত থাকায় খামারিদের লোকসানে পড়া। তৃতীয়ত, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমায় মাংস খাওয়া কমানো। 

করোনার সংক্রমণ দেখা দিলে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। মূলত তখন থেকে দেশে মাংস খাতে সংকটের শুরু। তারপর দেখা দেয় রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধসহ আন্তর্জাতিক ও দেশের অভ্যন্তরীণ নানা সংকট। মূল সংকট তৈরি হয়েছে পোলট্রি ও গোখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে। এতে লাভবান না হতে পেরে অনেক খামারি ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। 

পোলট্রি ও পশুখাদ্য উৎপাদনকারীরা বলছেন, পোলট্রি ও গোখাদ্য উৎপাদনের উপাদান অনেকটাই কাছাকাছি। খাদ্য উৎপাদনে ভুট্টা ও সয়াবিন কেক (সয়াবিন বীজ থেকে তেল বের করার পর যে অংশ থাকে) ব্যবহৃত হয় ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ। এর মধ্যে ৬০–৬৫ ভাগ ভুট্টা ও ২০–২৫ ভাগ সয়াবিন কেক। বাকি ১৫–২০ ভাগ ব্যবহৃত হয় অন্যান্য উপাদান। 

করোনার আগে প্রতি কেজি ভুট্টার দাম ছিল ১৮ থেকে ২২ টাকা। করোনার পর এটা সর্বোচ্চ ৪২ টাকা পর্যন্ত হয়েছিল, এখন দাম ৩৬ টাকা। আর সয়াবিন কেকের দাম করোনার আগে ছিল প্রতি কেজি ছিল ৫০–৫৪ টাকা। তারপর দাম সর্বোচ্চ হয় ৮৫ টাকা। এখন ৮০–৮২ টাকা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, প্রধানত তিনটি কারণে উৎপাদন কমেছে। প্রথমত, করোনার পর থেকে পোলট্রি ও গোখাদ্যের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, কয়েক বছর ধরে প্রচুর কোরবানির পশু অবিক্রীত থাকায় খামারিদের লোকসানে পড়া। তৃতীয়ত, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমায় মাংস খাওয়া কমানো। 

ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সভাপতি মো. মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাহিদার চেয়ে উৎপাদন কম হওয়ায় ভুট্টা ও সয়াবিনের দাম বেড়েছে। যাঁদের কাছ থেকে ভুট্টা ও সয়াবিন কেক পাই, তাঁদের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। ফলে পোলট্রি খাদ্যের দাম কমার লক্ষণ দেখি না।’ 

করোনার আগে পোলট্রি খামারি ছিলেন এক লাখের মতো। বর্তমানে প্রায় ৬০ হাজার। এরই মধ্যে আবার ২০ হাজার খামার মাঝেমধ্যে বন্ধ থাকে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পোলট্রি খাদ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেক প্রান্তিক খামারি লাভ করতে পারেন না। এক দিনের মুরগির বাচ্চার দামেও অস্বাভাবিক উত্থান-পতন। এসব কারণে লোকসান দিয়ে অনেকে ব্যবসা ছেড়েছেন। গুটিকয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেটের কারণেও খামারিরা লাভ করতে পারেন না বলে অভিযোগ তাঁর।

এদিকে সারা বছর দেশে যে পরিমাণ পশু জবাই হয়, তার প্রায় অর্ধেক হয়ে থাকে পবিত্র ঈদুল আজহায়। করোনা সংক্রমণ শুরুর বছর ২০২০ সাল থেকে কোরবানির পশু অবিক্রীত থাকার পরিমাণ বেড়েছে। সেই থেকে প্রতি কোরবানিতে ২১ লাখের ওপর পশু অবিক্রীত থাকছে। গত কোরবানির ঈদেও প্রায় ২৫ লাখ পশু অবিক্রীত ছিল। এতে লোকসানের শিকার হয়ে অনেক খামারি এ পেশা থেকে সরে গেছেন।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ রেয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, কোরবানির পশুর বড় একটি অংশ অবিক্রীত থাকায় গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ করা খামারিদের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতেও কিছুটা উৎপাদন কমেছে। 

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, দানাদার খাদ্যের দাম কমার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ফলে এমন খাদ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। বিকল্প হিসেবে অপ্রচলিত খাদ্য জনপ্রিয় করতে হবে।