তুরস্কের গাজিয়ানতেপ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জামিলা ইয়াসমিনের একমাত্র ছেলের বয়স মাত্র ১৪ মাস। তিনি মঙ্গলবার হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম আলোকে বললেন, ‘ঘুম ভেঙে ভূমিকম্পের তাণ্ডব দেখে ভেবেছিলাম এই বুঝি সব শেষ। ছয়তলা ভবনটি যেভাবে দুলছিল তা ছিল অকল্পনীয়। ভবনটি ভেঙে পড়বে মনে হয়েছিল। আল্লাহর রহমত যে আমরা এখনো বেঁচে আছি। তবে ভয় কাটেনি।’
জামিলা, তাঁর স্বামী মো. মোজাহিদুল ইসলামসহ ২০ জনের মতো বাংলাদেশি বর্তমানে গাজিআনেতপ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে জামিলারই এত ছোট সন্তান আছে।
বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেয়ে জামিলা। তাঁর স্বামী বেশ কয়েক বছর ধরে তুরস্কে আছেন, সেখানেই চাকরি করছেন। আর জামিলা তুরস্কে যান ২০২০ সালে। তাঁরা গাজিয়ানতেপ শহরে আছেন ২০২১ সালের জুলাই মাস থেকে।
স্থানীয় সময় সোমবার ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে এ ভূমিকম্প হয়। ৭ দশমিক ৮ মাত্রার এই ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে। সে কারণে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতিও সেখানেই বেশি হয়েছে। গাজিয়ানতেপ শহরে ২০ লাখের মতো মানুষের বসবাস।
জামিলা বলেন, ভূমিকম্পের কাঁপুনি থামার পর তাঁরা বাসার নিচে নামেন। বাইরে তখন প্রচণ্ড ঠান্ডা, বৃষ্টিও ছিল। পরে আবার বাসায় গিয়েছিলেন গরম কাপড় আনার জন্য। মুঠোফোন, নিজেদের আর বাচ্চার গরম কাপড় ছাড়া সঙ্গে আর তেমন কিছু আনতে পারেননি। এমনকি পাসপোর্ট বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রও আনতে পারেননি।
জামিলা বলেন, ‘আবার বাসায় যখন যাই তখন দেখেছি ভবনে ফাটল ধরেছে। জানি না আমাদের কত দিন বাসার বাইরে থাকতে হবে। কবে আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব, তাও জানি না। একাধিক ভূমিকম্প, আফটার শক তো থামে নেই। এখন যে মসজিদে আছি সেখানে অন্যান্য বাংলাদেশিরা আছেন এটা একটু ভরসা দিচ্ছে। আর পৌরসভা থেকে খাবার দিচ্ছে। শৌচাগারসহ অন্যান্য ব্যবস্থাও ভালো।’
জামিলা জানালেন, তাঁর বাসা থেকে এ মসজিদটি বেশ দূরে। হেঁটে, ট্যাক্সি করে আসতে হয়েছে। প্রথমে পুরো শহরে পানি না থাকলেও এখন পানি আছে।
প্রথম আলোর সঙ্গে কথা শেষ করার পর জামিলা নিজেই আবার হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দেন। বলেন, ‘এমন ভয়ের মধ্যে আছি, একটু আগে যা বলছি, তা–ও ভুলে যাচ্ছি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা জানিয়েছে, গাজিয়ানতেপ এলাকাটির বেশির ভাগ ভবনই শুধু ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, যা খুবই ভঙ্গুর।
জামিলার সঙ্গে একই মসজিদে আছেন কুমিল্লার মো. সাইয়েদুল হাসান। গাজিআনতেপ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষার্থী হোয়াটসঅ্যাপে জানালেন, গত ছয় বছর ধরে এই শহরে আছেন। ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ল্যাপটপে কাজ করছিলাম। ভেবেছিলাম ফজরের নামাজ পড়ে একবারে ঘুমাতে যাব। হঠাৎ বুঝলাম ভূমিকম্প হচ্ছে। কিন্তু এ তো থামে না। দুলুনি বেড়েই চলেছে। টেবিলের নিচে বসে ছিলাম।’
ভূমিকম্পের সময় সাইয়েদুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উম্মে কুলসুম স্টুডেন্ট হোস্টেলে ছিলেন। বিভিন্ন দেশের প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী ছিলেন হোস্টেলটিতে। সাইয়েদুল বলেন, নিচে নামার পর প্রায় আধঘণ্টা খোলা মাঠে ছিলেন। তারপর মসজিদে আশ্রয় নেন। এক কাপড়েই দুদিন কাটিয়ে দিয়েছেন। মসজিদে খাবার আসতে একটু দেরি হচ্ছে, তবে খাবার পাচ্ছেন তাঁরা।
সাইয়েদুল বললেন, ‘ভূমিকম্পের এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এই প্রথম। মুঠোফোন, মানিব্যাগ ছাড়া সঙ্গে আর কিছু নেই। এভাবে কত দিন থাকতে হবে তাও তো জানি না।’
গাজিয়ানতেপ ইউনিভার্সিটির আরেক শিক্ষার্থী ইশরাত ফাতেমা জান্নাতও বর্তমানে মসজিদটিতে আশ্রয় নিয়েছেন। জানালেন, ভূমিকম্পের সময় তিনি একটি বেসরকারি হোস্টেলে ছিলেন। হোস্টেলে সাইরেন বাজতে থাকে, চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। প্রথমে ভেবেছিলেন কয়েক সেকেন্ডে থেমে যাবে, তবে ৫ থেকে ৬ মিনিট ভবন দুলতে থাকে। ভবনে ফাটল দেখা দেয়। তাঁরা যে যে অবস্থায় ছিলেন নিচে নেমে আসেন। নিচে নামার পর বরফে খালি পায়ে, গরম পোশাক ছাড়া থাকায় বেশ কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ইশরাত ফাতেমা বলেন, পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ ছিল তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যরা বুঝতেও পারবে না।