নগর–পরিকল্পনাবিদের অভিমত

সামগ্রিক গাফিলতির আরেক উদাহরণ

আদিল মুহাম্মদ খান
আদিল মুহাম্মদ খান

আবার ভয়াবহ আগুন ও মর্মান্তিক মৃত্যুর পুনরাবৃত্তি ঘটল রাজধানী ঢাকায়। ৪৬ মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে সামগ্রিক গাফিলতির আরেকটি উদাহরণ আবার সামনে এল।

অগ্নিকাণ্ড হতেই পারে। অনেক বড় বড় শহরেও অগ্নিকাণ্ড হয়, কিন্তু ঢাকার মতো না। এভাবে নির্বিচার মানুষ মারা যায় না। এটা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। এটা দুর্ঘটনা নয়, এর পেছনে অনেক ধরনের গাফিলতি জড়িত। এ পরিস্থিতির খুব দ্রুত পরিবর্তন হবে এবং আপাতদৃষ্টে একটি নিরাপদ নগরে বসবাস করতে পারব; এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

আগুনে পুড়ে যাওয়া বেইলি রোডের ভবন

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর বেইলি রোডের ওই ভবনে যাঁরা খেতে গিয়েছিলেন বা কোনো কাজে গিয়েছিলেন, তাঁরা ভরসা করেছিলেন রাষ্ট্রের ওপর। কারণ, রাষ্ট্র ওই ভবনের অনুমোদন দিয়েছে। জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং এর সংস্থাগুলোর। এ রাষ্ট্রের কিছু সংস্থা আছে, যারা মূলত অনুমোদন দেয়, নোটিশের কিছু কাগজ তৈরি করে। কিন্তু পৃথিবীতে যেসব শহরে সুশাসন এবং মানুষের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত, সেখানকার সংস্থাগুলো শুধু কাগজ তৈরি করে না; নিয়মিত পরিদর্শন করে, কারও দোষ পেলে শাস্তি দেয়। অনিরাপদ অবস্থায় ভবন পরিচালিত হবে, সেখানে মানুষ যাবে এবং আগুন লাগলে মারা যাবে, এটা কোনোভাবেই অনুমোদন দেয় না তারা। যখনই অনিয়ম পায়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়। আমাদের সেই সংস্কৃতি তৈরি হয়নি; বরং অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন মালিক ও প্রভাবশালীরা সংস্থাগুলোকে ম্যানেজ করে ফেলে।

বেইলি রোডের ভবনটিতে বাণিজ্যিক অনুমোদন নেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রভাবশালী মহলের চাপ ছিল বলে শোনা যাচ্ছে। যে কারণে ভবনটিকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনায় শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে বাণিজ্যিক ব্যবহার ও রেস্তোরাঁ পরিচালনা দুটি ভিন্ন ব্যবহার। যেখানে মাত্র একটি সিঁড়ি, এমন একটি ভবনে রেস্তোরাঁ চলতে পারার কথা না। তাহলে রাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসেবে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন—তাদের ভূমিকা কি কেবল নোটিশ দেওয়া? যাঁরা প্রভাবশালী, তাঁরা কি এতগুলো মানুষের জীবনের চেয়েও প্রভাবশালী? তাঁরা কীভাবে দিনের পর দিন এগুলোর পুনরাবৃত্তি করছেন? এত দুর্ঘটনার পরও কি রাষ্ট্রের টনক নড়বে না?

চুড়িহাট্টার ঘটনার এত বছর পরও পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদামগুলো পুরোপুরি সরানো যায়নি। অথচ অন্য ক্ষেত্রে ঢাকার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ অনেক উড়ালসড়ক হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে আমরা সফল হতে পারলাম। কিন্তু রাসায়নিক গুদাম, যার সঙ্গে জীবনের নিরাপত্তা ভয়ংকরভাবে জড়িত, যেখানে অনেকগুলো অগ্নিকাণ্ডের মুখোমুখি হয়েছি, সে ক্ষেত্রে কেন পারলাম না?

ঢাকা এতটাই অপরিকল্পিত যে এখানে পুরোপুরি পরিকল্পিত নগরায়ণ সম্ভব নয়। কিন্তু যেটা সম্ভব, সেটা হচ্ছে ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন; যার মাধ্যমে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে, সেটাকে তুলনামূলক কিছুটা কমিয়ে আনা। এর জন্য প্রতিটি সংস্থা তার নজরদারি কার্যক্রমগুলো নিশ্চিত করবে। কিন্তু এর জন্য যে ধরনের অভিযান দরকার, সেটার অনুপস্থিতি আছে। সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ মুখে বললেও সংস্থাগুলো পরিচালনায় বিভিন্ন পর্যায়ে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের অনেকে অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। এ ধরনের ঘটনায় জমি বা ভবনের মালিক থেকে শুরু করে সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থার কারা দায়ী, তাঁদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনার দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে।

এ ছাড়া বাংলাদেশে ভবনের মিশ্র ব্যবহার অনুমোদনের ক্ষেত্রে আরও ভাবা দরকার। ভবনে আলো–বাতাস প্রবাহের সুযোগ না রেখে কাচ দিয়ে ঘিরে পুরো ভবনকে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বিপদকে যেভাবে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, সেটা পেশাজীবী, স্থপতি, প্রকৌশলী ও পরিকল্পনাবিদ—সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে।

আদিল মুহাম্মদ খান: সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স