ত্রিশালে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে দ্রুতগামী ট্রাকের চাপায় মারা গেছে শিশুটির বাবা, মা ও ছয় বছর বয়সী বোন।
মামির কোলে থাকা নবজাতকের সারা শরীর কাপড় দিয়ে ঢাকা। শুধু ছোট্ট মুখখানি দেখা যায়। চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। তবে তার এই ঘুম অন্য নবজাতকের মতো নয়। কিছুক্ষণ আগেই এক ভয়ানক ‘ঝড়ের’ মধ্যে এ পৃথিবীর আলো দেখেছে সে।
যে সময় এ নবজাতক জন্মেছে, ঠিক সেই সময় পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে তাকে রেখে চিরবিদায় নিয়েছেন মা, বাবা আর বোন। ময়মনসিংহের ত্রিশালে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কোর্ট ভবন এলাকায় সড়ক পার হওয়ার সময় দ্রুতগামী ট্রাকের চাপায় মারা গেছেন শিশুটির বাবা জাহাঙ্গীর আলম (৪২), মা রত্না বেগম (৩২) ও ছয় বছর বয়সী বোন সানজিদা।
গতকাল শনিবার বেলা তিনটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পরপর ঘটনাস্থলে ভিড় করেন বিপুলসংখ্যক মানুষ।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন সুমন মিয়া। তাঁর ভাষ্য, কোর্ট ভবন এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দ্রুতগতিতে অতিক্রম করছিল একটি ট্রাক। একই সময় ওই সড়ক পার হচ্ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রত্না বেগম। সঙ্গে ছিল শিশু সানজিদা। মুহূর্তের মধ্যে ট্রাকটি তাঁদের চাপা দিয়ে চলে যায়। ট্রাকচাপায় পেট চিড়ে যায় রত্না বেগমের। তখন নবজাতক মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে সড়কে পড়ে ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ট্রাকচাপায় ঘটনাস্থলেই মারা যান নবজাতকের মা ও বাবা। স্থানীয়রা ছুটে এসে তাকে ও তার বোন শিশু সানজিদাকে ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পাঠান। তখন চিকিৎসক সানজিদাকেও মৃত ঘোষণা করেন। পরে নবজাতককে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের পরামর্শে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
স্বজনদের সূত্রে জানা গেছে, জাহাঙ্গীর–রত্না দম্পতির বাড়ি ত্রিশাল উপজেলার রায়মনি গ্রামে। চিকিৎসকের ঘোষণা অনুযায়ী অন্তঃসত্ত্বা রত্নার সন্তান প্রসবের সময় পার হয়ে গিয়েছিল। গতকাল সকালে জাহাঙ্গীর আলম স্ত্রীকে ত্রিশালের একটি ক্লিনিকে নিয়ে যান। আলট্রাসনোগ্রাম শেষে বাড়িতে ফেরার সময় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক পার হচ্ছিলেন তাঁরা। তখন ট্রাকটি চাপা দেয় তাঁদের।
জাহাঙ্গীর আলম পেশায় কৃষক। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন কাজে শ্রমিক হিসেবেও খাটতেন। সর্বশেষ ত্রিশালের একটি রেস্তোরাঁয় শ্রমিকের কাজ করতেন।
রায়মনি গ্রামে দুর্ঘটনায় একসঙ্গে তিনজনকে হারানোর শোক যখন সামাল দিচ্ছিলেন স্বজনেরা, তখন দূরসম্পর্কের আত্মীয়রা ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নবজাতকের চিকিৎসার কাজে ছিলেন ব্যস্ত। পরে শিশুটিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে ভিড় থাকায় শিশুটিকে কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান স্বজনেরা। এরপর সেখান থেকে নিয়ে যান ময়মনসিংহ নগরের বেসরকারি লাবীব হাসপাতালে।
কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক করিম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নবজাতকটি আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। তার অবস্থা খারাপ নয়। প্রাথমিকভাবে শিশুটির হাত ভেঙে গেছে বলে জানা গেছে।’
অন্যদিকে লাবীব হাসপাতালের স্বত্বাধিকারী মো. শাহ জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুটির বাবা আমার প্রতিবেশী। তাঁরা নিহত ও নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার খবর জানার পরই আমি শিশুটির চিকিৎসায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। চিকিৎসকদের পরামর্শে আমি সবকিছু করছি।’ হাতে প্লাস্টার করানোর পর চিকিৎসকদের অনুমতি পেলে নবজাতককে নিজের বাড়িতে নিয়ে রাখা হবে বলে জানান তিনি।
শাহ জাহান আরও জানান, নিহত জাহাঙ্গীর আলম দরিদ্র মানুষ ছিলেন। তাঁর বাবা মোস্তাফিজুর রহমান এখনো জীবিত আছেন। তবে তিনি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। কোনো কাজ করার ক্ষমতা নেই। ফলে নবজাতকটির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হতে পারে।
শিশুটির চাচা আরিফ রব্বানির সঙ্গে কথা হয় কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে শোকের ছায়া। রাতে তিনজনের লাশ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একটি পরিবারের তিন সদস্যের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর পর আসলে পুরো গ্রামের মানুষ শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। রাতেই তিনজনের লাশ দাফন করা হয়েছে।’
জন্মের পর থেকেই নবজাতকটিকে কোলে আগলে রাখা মামি রোজিনা খাতুন অবশ্য কোনো কথা বলতে পারেননি। বাবা–মা–বোন হারানো এই শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁদের কী পরিকল্পনা জানতে চাইলে রোজিনা ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন।
দুর্ঘটনার পর থেকে ট্রাকচালক পলাতক রয়েছেন বলে জানিয়েছেন ত্রিশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাঈন উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই তিনজনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বক্তব্য
ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুনিরা ফেরদৌসী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নবজাতকের খুব কাছের আত্মীয়ের কাছেই তাকে রাখতে হবে। আত্মীয়দের মধ্যে কোনো স্তন্যদায়ী থাকলে তাঁর দুধ তাকে খাওয়াতে হবে। যদি সম্ভব না হয় তাহলে নবজাতকের জন্য তৈরি কৃত্রিম দুধ খাওয়াতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কীভাবে সেই দুধ তৈরি করতে হবে, কীভাবে খাওয়াতে হবে, তা ঠিকমতো জানতে হবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে। শিশুটিকে নরম কাপড়ের মধ্যে রাখতে হবে। ঠান্ডা, ধুলা থেকে দূরে রাখতে হবে।’