মন্ত্রণালয়ের প্রতিবাদ ও প্রতিবেদকের বক্তব্য

‘আগেই জমি কিনে নেন মন্ত্রী ও তাঁর ছেলেমেয়ে’ শিরোনামে গত বুধবার প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা মো. মাইদুল ইসলাম প্রধান স্বাক্ষরিত প্রতিবাদপত্রটি গত বৃহস্পতিবার পাঠানো হয়।  

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মানিকগঞ্জে সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) কারখানা করার জন্য প্রস্তাবিত জমির বড় অংশ অধিগ্রহণের আগেই কিনে নিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, তাঁর ছেলে-মেয়ে ও এক স্বজন। পরে সেই জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয় এবং জমি বিক্রি ও হস্তান্তর করেন মন্ত্রী–পরিবারের সদস্যরা। এই প্রক্রিয়ায় জমির মৌজামূল্য পাঁচ গুণ বাড়ানো হয়। এতে ওই জমি অধিগ্রহণে সরকারের প্রায় ১০০ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় হবে বলে জেলা প্রশাসক এক চিঠিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন। 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তার সই করা প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, প্রকাশিত প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে এবং মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নিজের নাম ও মন্ত্রীর সন্তানের নামে জমি ক্রয়ের যে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে কিংবা তাঁর ছেলে-মেয়ে উল্লিখিত জমির কোনো অংশই কেনেননি। ২০১৬ সালে সান পাওয়ার কোম্পানির নামে অল্প কিছু জমি কেনা হয়েছিল, যা ২০১৯ সালেই বিক্রি করা হয়েছে। 

প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, ইডিসিএলের প্রকল্পটি ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস হয়। সাত–আট বছর আগে কেনা ও বিক্রি করা জমির মিথ্যা মালিকানা তুলে ধরে ২০২৩ সালের ৫ জুলাই সংবাদ পরিবেশনকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবাদপত্রে। উল্লিখিত স্থানে ইডিসিএল প্রকল্প করার ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত জমি ক্রয় করা বাবদ একটি পয়সাও ব্যয় করা হয়নি। কোনো রকম জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি, জমিও কোনো রকম চূড়ান্ত করা হয়নি। প্রকাশিত সংবাদে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে।

জমির শ্রেণি পরিবর্তন ও মৌজামূল্য বৃদ্ধি শুধু আইন মন্ত্রণালয় করতে পারে। জমির মূল্য কেউ কখনো বেশি প্রদর্শন করে না। কারণ, জমির দাম বেশি দেখালে সরকারকে সে অনুযায়ী বেশি রাজস্ব দিতে হয়।

প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, সরকারের আর্থিক ক্ষতি এড়াতে পার্শ্ববর্তী মৌজায় সরকারি ওষুধ কারখানার প্রকল্প স্থাপন করলে ১০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে—এই বিষয় কাল্পনিক। কেননা, বর্তমানের নির্ধারিত স্থানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলেও জমির মোট মূল্য ১০০ কোটি টাকার অনেক কম হবে। সে ক্ষেত্রে শতকোটি টাকা সাশ্রয়ের কোনো সুযোগ নেই। 

প্রতিবাদপত্রে উল্লেখ করা হয়, প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলা হয়েছে; কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনো জমি ক্রয়, অধিগ্রহণ কোনোটিই হয়নি। প্রকল্পের জমি নির্বাচন ও ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়াদি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও জেলা প্রশাসকের এখতিয়ারভুক্ত, যার সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও তাঁর পরিবারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়টি অযৌক্তিক।

জমি অধিগ্রহণে জেলা প্রশাসক বিভিন্ন অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করছেন উল্লেখ করে প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, মন্ত্রণালয় থেকে জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রায় এক বছর আগে অনুরোধ করা হলেও জেলা প্রশাসক জমি অধিগ্রহণে উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রম হাতে নেয়নি। উল্টো ৪ ধারার নোটিশ জারি করে জমি অধিগ্রহণে বিলম্ব করেন এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন অজুহাতে সময় ক্ষেপণ করতে থাকেন। ফলে মুদ্রাস্ফীতির কারণে জমির মূল্য আরও বেড়ে গিয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

আবার তিনি (জেলা প্রশাসক) কী কারণে সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে জমির মূল্য নির্ধারণের ব্যাপারে একটি চিঠি প্রদান করেন তা–ও বোধগম্য নয়। এ ধরনের সংবাদ পরিবেশনে সহায়তা করে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক কার উদ্দেশ্য পূরণ করছেন তা–ও বোধগম্য নয়। যেখানে কোনো কাজই শুরু হয়নি এবং যেখানে কোনো অর্থই খরচ হয়নি, সেখানে এ ধরনের অসত্য সংবাদ পরিবেশন অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: 

জমি কেনাবেচার দলিল অনুযায়ী প্রকল্পটির প্রস্তাবিত জায়গায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মালিকানাধীন বিডি সান পাওয়ার কোম্পানির নামে ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৬ দশমিক ৩৯ একর জমি কেনা হয়। মন্ত্রীর ছেলে রাহাত মালেকের মালিকানাধীন রাহাত রিয়েল এস্টেটের নামে ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৩ দশমিক ১২ একর জমি কেনা হয়।

দলিলে বিডি সানের নামে কেনা জমির গ্রহীতা হিসেবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সই এবং রাহাত রিয়েল এস্টেটের নামে কেনা জমির গ্রহীতা হিসেবে রাহাত মালেকের সই রয়েছে। এসব জমি তাঁরা প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার এক মাস আগে ২০২২ সালের মার্চে বিক্রি করেন। সেখানেও দাতার স্থলে মন্ত্রী ও তাঁর ছেলের সই রয়েছে। মন্ত্রীর মেয়ে সিনথিয়া মালেক ২০২১ সালে কেনেন ১১ দশমিক ১৪ একর জমি। তিনি তা ২০২২ সালের ১৬ মার্চ তাঁর স্বামী আজমল আকমলের নামে হস্তান্তর করেন। 

জমি কেনাবেচার দলিলের তথ্য অনুযায়ী, ইডিসিএলের কারখানা করার প্রস্তাবিত জায়গায় নাল জমি (নিচু জমি) কেনা হয়েছিল। পরে মাটি ভরাট করে তা ভিটি (বাড়ি) জমি দেখিয়ে হস্তান্তর করা হয়। 

এদিকে ওই মৌজায় ভিটি শ্রেণির জমির মৌজা মূল্য বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী আইন মন্ত্রণালয়ে আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) দিয়েছিলেন। 

প্রায় ১০০ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয়ের আশঙ্কার হিসাবটি জেলা ভূমি ব্যবস্থাপনা কমিটির। মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যে চিঠি দিয়েছেন, সেখানে এই হিসাব উঠে এসেছে। আর ক্ষমতার অপব্যবহার-সংক্রান্ত বক্তব্যটি একজন স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষকের মতামত। এটা প্রথম আলোর কোনো বক্তব্য নয়।