রাজশাহীতে বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ে দেওয়ার আয়োজন করা হয়। গত সোমবার দুপুরে জেলার চারঘাট উপজেলার তাতারপুর গ্রামে
রাজশাহীতে বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ে দেওয়ার আয়োজন করা হয়। গত সোমবার দুপুরে জেলার চারঘাট উপজেলার তাতারপুর গ্রামে

ব্যাঙের বিয়ে দিলে কি সত্যিই বৃষ্টি আসে

তীব্র তাপপ্রবাহে বিপর্যস্ত দেশের মানুষ। সাধ্য অনুযায়ী প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে চাইছেন সবাই। কিন্তু তাপমাত্রা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার গণমাধ্যমে এসেছে

ব্যাঙের ‘বিয়ের’ একটি খবর। বৃষ্টির আশায় রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় বেশ কয়েকজন মিলে দুটি ব্যাঙের ‘বিয়ে’ দিয়েছেন। নাটোরেও ব্যাঙের বিয়ের খবর পাওয়া গেছে।

এখানে একটি প্রশ্ন ওঠে। তা হলো—ব্যাঙের বিয়ে দিলে কি সত্যিই বৃষ্টি নামে? আর এর প্রচলনই–বা হলো কেমন করে? এসব প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের আগে জানা প্রয়োজন, ব্যাঙের বিয়ে আসলে কীভাবে দেওয়া হয়। অঞ্চলভেদে এই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় রকমফের হয়। তবে উদ্দেশ্য যেহেতু এক, তাই মূল পর্বের আনুষ্ঠানিকতার রীতিও অনেকটা অভিন্ন।  

ব্যাঙের বিয়ের খবর পেয়ে প্রথম আলোর রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, চারঘাটে কলাগাছের খোল দিয়ে দুটি বাক্সের মতো বানিয়ে তাতে রাখা হয় দুটি ব্যাঙ। গ্রামের ছেলেমেয়ে ও নারী–পুরুষেরা শরীরে রং মাখেন। ব্যাঙের গায়েও দেওয়া হয় রং। তারপর ব্যাঙ দুটিকে বাক্সে ঝুলিয়ে বাড়ি বাড়ি নিয়ে যায় এই দল। সব বাড়ি থেকে দেওয়া হয় মুঠো চাল।

আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদের ভাষ্যমতে, ওই দল গ্রামের বাড়িগুলোর উঠানে পানিও ঢেলে দিয়েছে। তারপর ওই কাদাপানিতে গড়াগড়ি খেয়েছে তারা। এরপর এক জায়গায় ফিরে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া হয়। পরে ছোট একটি গর্ত করে তাতে পানি ঢেলে ছেড়ে দেওয়া হয় ব্যাঙ দুটিকে। এই আয়োজনে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গাওয়া হয়—‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই, আল্লাহ মেঘ দে’ গান। এটি হলো বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা।

ব্যাঙের বিয়ে দেওয়ার এই সংস্কৃতি রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা ফরিদপুরেও। জেলাটির সদর উপজেলার বাখুন্ডা ইউনিয়নের দয়ারামপুরের হোসনে আরা ও আসমা আক্তার এখন মাঝবয়সী। তাঁরাও কিশোর বয়সে বৃষ্টি আনতে পালন করেছেন এই লোকাচার।  
হোসনে আরা মঙ্গলবার মুঠোফোনে জানান, বিয়ে দেওয়ার জন্য দুটি গর্ত করে একটিতে স্ত্রী ব্যাঙ, অপরটিতে পুরুষ ব্যাঙ রাখতেন তাঁরা। আমপাতাসহ বিভিন্ন গাছের পাতাধোয়া পানি দিয়ে গোসল করানো হতো ব্যাঙ দুটিকে। সেগুলোকে পরিয়ে দেওয়া হতো বিয়ের পোশাক। এরপর বিয়ে দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো পুকুরে। মানুষের বিয়ের উৎসবের মতো গাওয়া হতো নানা গীত। পুরো গ্রামের মানুষ তখন উপস্থিত থাকতেন। তাঁদের বিশ্বাস ছিল—এর পরই আসবে বৃষ্টি।

যখন কোনো উৎসবে প্রাণী, বৃক্ষ, মাটি, কাদা ও পানির মতো উপকরণের উপস্থিতি থাকে, তখন বলার অপেক্ষা থাকে না যে তা কৃষি–সম্পর্কিত লোকাচার থেকে আসা এক সংস্কার। কৃষি লোকাচার নিয়ে বলতে গেলে আসে খনার বচনের কথা। বৃষ্টি নিয়ে খনার বচনের ইতিহাসটা জানা যাক। খনা বলছেন, ‘কী করো শ্বশুর লেখাজোখা।/ যদি বর্ষে রিনিঝিনি, ধানের ভার না সহে ধরণি।/ যদি বর্ষে মুষলধারে, মধ্যসমুদ্রে বগা চরে।/ যদি বর্ষে ছিটেফোঁটা, পর্বতে হয় মীনের ঘটা।/ সূর্য হেসে বসে পাটে, সেবার শস্য না হয় মোটে।’

হীরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘বাংলার লোক-উৎসব ও লোকশিল্প’ বইয়ে খনার এই বচনের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই বচনে খনা তাঁর জ্যোতিষী শ্বশুর বরাহকে বলছেন, আজ আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথি। বছরে কেমন শস্য-সম্পদ হবে, তা জানার জন্য আজ খড়ি পেতে আঁকাজোকা করে গণনার কোনো দরকার নেই। এই দিনে হওয়া বৃষ্টিই সেসব তথ্য স্পষ্ট করে দেবে। এদিন যদি মৃদুমন্দ গতিতে, ধীরছন্দে বৃষ্টি হয়, তাহলে বুঝতে হবে, সে বছর এত ধান হবে যে পৃথিবী তার বোঝা বইতে পারবে না। কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টি হলে এমন শুষ্কতা দেখা দেবে, মাঝসমুদ্রও শুকিয়ে যাবে, আর সেখানে বক চরবে। এদিন অল্প বৃষ্টি হলে সে বছর এত মাছ হবে যে পাহাড় জমে যাবে। আর এদিন যদি আকাশ মেঘহীন থাকে এবং সন্ধ্যায় মেঘমুক্ত অবস্থায় সূর্য অস্ত যায়, তবে বুঝতে হবে, সে বছর ধানের দফারফা হয়ে যাবে।

ধারণা করা হয়, খনার জন্ম অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে। অর্থাৎ বৃষ্টি সম্পর্কে আগাম ধারণা পাওয়া এবং আবহাওয়া দেখে ফসল কেমন হবে, সে সম্ভাবনা যাচাইয়ের রীতি হাজার বছর আগেও প্রচলিত ছিল বাংলায়। ব্যাঙের বিয়ে তারই একটি অংশ। এটি একটি ব্রত। ঠিক কবে থেকে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়ার মতো লোকাচারের শুরু, তা নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। তবে এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের লেখক সন্তোষ কুমার কুণ্ডু একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

সন্তোষ কুমার তাঁর ‘বাঙালি জীবনের লোকাচার’ বইয়ে লিখেছেন, ‘ব্রতকে ধর্মের আদিস্তরে স্থাপন করে বিবেচনা করেছেন বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতিবিদ স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজার। তাঁর মতে, ব্রত আসলে আদিমানুষের জাদুক্রিয়া। এখানে আছে ইচ্ছার প্রকাশ। ইচ্ছা জনসম্পদ–ধনসম্পদের, ইচ্ছা ভৌতিক–আধিভৌতিক স্তরের অসুবিধা থেকে মুক্তির জন্য। ইচ্ছার সঙ্গে থাকে ইচ্ছাপূরণের, প্রতিস্থাপনের চেষ্টাও। জাদুক্রিয়াকে ফ্রেজার ভেবেছেন ত্রিমাত্রিক; প্রথম, যা চাই তার প্রতি প্রার্থনাধর্মী; যা চাই তা অভিনয় করে। বৃষ্টি প্রার্থনার জাদু যেমন। বৃষ্টির দেবতার প্রতি প্রার্থনা বাংলার জল মাঙনের ব্রত যেমন। বৃষ্টির অনুকরণ জল ছেটানোর অনুষ্ঠান, নন্দোৎসব, ধুলোট প্রভৃতি ব্রতাচারে এমন লক্ষ করা যায়।’

তাই বৃষ্টির প্রত্যাশায় ব্যাঙের বিয়ে হচ্ছে এমন এক ব্রত, যা বাঙালির জীবনের লোকাচারের অংশ। আধুনিক বিজ্ঞানধর্মী মন এসব মানতে চায় না। কিন্তু মানুষ কি শুধু প্রার্থনাই করে, চেষ্টা করে না? ব্রত মানুষের জীবনের সবখানি নয়। ব্যাঙের বিয়ে দিলে বৃষ্টি আসবেই বা অতীতেও সব সময় হয়েছে—এমন নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারবেন না। কিন্তু এ হচ্ছে প্রত্যাশা। যে প্রত্যাশা সব মানুষের ভেতরেই কোনো না কোনোভাবে থাকে।