সুন্দরবনে গত ২২ বছরে ২৫ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সবগুলোই ঘটেছে পূর্ব সুন্দরবন এলাকায়। এসব আগুনের ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, বেশির ভাগ আগুন লেগেছে জেলে-মৌয়ালদের অসাবধানতায়। যদিও এ নিয়ে বনজীবীদের দ্বিমত আছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনে এবার আগুন জ্বলছে পূর্ব বন বিভাগের ভোলা নদী থেকে সোয়া দুই কিলোমিটার দূরে আমোরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির লতিফের ছিলা এলাকায়। এর আগের আগুনটি ছিল ২০২১ সালের মে মাসে পূর্ব সুন্দরবনে দাসের ভারানির পাশের অঞ্চলে। সব মিলিয়ে ২০০২ সাল থেকে গতকালের আগপর্যন্ত ঘটা ২৪টি অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত করেছে পূর্ব বন বিভাগ।
বন বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২৪টি আগুনের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৩ লাখ ৫৩৩ টাকা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অগ্নিকাণ্ডে প্রাণী বৈচিত্র্য ও পরিবেশের ক্ষতি ধরা হয় আনুমানিক হিসাবে। ফলে এই হিসাবে যে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র আসেনি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ ছাড়া প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, অধিকাংশে আগুনের সূত্রপাতের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, জেলে-মৌয়ালদের অসাবধানতায় আগুন। অর্থাৎ জেলে-মৌয়ালদের বিড়ি-সিগারেট বা মৌমাছি তাড়াতে জ্বালানো মশাল থেকেই সবচেয়ে বেশি আগুনের সূত্রপাত হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা আগুন লাগার কারণ নিয়ে দ্বিমত আছে বনজীবীদের। ২০২১ সালে আগুনের ঘটনার পর প্রথম আলো কথা বলেছিল বনজীবী শরণখোলার আফজাল হোসেনের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। তখন তিনি কাজ করতেন কমিউনিটি পেট্রল গ্রুপের (সিপিজি) হয়েও। বিনা বেতনের এই কাজের সূত্রে দাসের ভারানির অগ্নিকাণ্ডের সময় টানা চার দিন উপস্থিত ছিলেন ঘটনাস্থলে। তিনি বলেছিলেন, মশাল বা বিড়ি-সিগারেট থেকে আগুন তখনই লাগতে পারে, যখন এই জেলে-মৌয়ালরা অসচেতন থাকেন। কিন্তু নিজের একমাত্র জীবিকার স্থানে কেউ অসচেতন থাকেন না। তাঁদের সচেতন থাকতেই হয়। কারণ প্রথমত, মধু বা মাছ সংগ্রহের জন্য তাঁদের একই জায়গায় বারবার যেতে হয়। দ্বিতীয়ত, অপরাধ প্রমাণিত হলে বন আইনের কঠোর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ তাঁদের নেই।
আগুনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি সন্দেহ থাকে মৌয়ালদের মশাল নিয়ে। মধু সংগ্রহের জন্য প্রতি মৌসুমে কয়েক দিনের জন্য বনে প্রবেশ করেন মধু-গবেষক সৈয়দ মুহাম্মদ মঈনুল আনোয়ার। বিভিন্ন বহর নিয়ে বনে যাওয়া মঈনুল আনোয়ার প্রথম আলোকে মশাল বানানো আর তা নিভিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার কথা জানিয়েছিলেন। মঈনুল বলেন, ‘ভেতরের শুকনা পাতা বেঁধে বাইরের দিক কাঁচা পাতা দিয়ে বানানো হয় মশাল। স্থানীয় মানুষ ডাকে “কারু” নামে। ভেতরের শুকনা পাতা বেশি থাকে না। সেটা পুড়ে কাঁচা পাতায় আগুন ধরার চেষ্টা করলে ধোঁয়া ছড়ায়। এই “কারু” একটি চাক কাটতে কাটতেই নিভে যায়। যদি অবশিষ্ট থাকেও তাহলে তা পানি বা ভেজা মাটিতে গুঁজে নিভিয়ে দেওয়া হয়।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এবারের আগুনের স্থান আমোরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির লতিফের ছিলা এলাকায়। সেখানে মাছ ধরার কোনো বিল নেই। হাঁটাপথ আছে যাতায়াতের। সেখানে আগুন কেমন করে লেগেছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে বন বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর।
আজ বেলা একটার দিকে সুন্দরবনে আগুনের ঘটনাস্থলে ছিলেন প্রথম আলোর বাগেরহাট প্রতিনিধি সরদার ইনজামামুল হক। তিনি মুঠোফোনে জানালেন, হেলিকপ্টার দিয়ে পানি দেওয়া হচ্ছে। এর আগে সকালে দুই দফায় হেলিকপ্টারে ওই এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, হেলিকপ্টারের বাতাসে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ চলছে। তাদের সহযোগিতা করতে বন বিভাগ, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের পাশাপাশি যোগ দিয়েছে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর দুটি আলাদা দল।
প্রতিবারই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খেতে হয় সংশ্লিষ্টদের। গতবার আগুনের ঘটনায়ও ‘কর্ডন’ বা ‘ফায়ার লাইন’ (আগুন নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ রাখতে চারদিকে নির্দিষ্ট গভীরতায় ভূমি খনন) তৈরি করতে হিমশিম খেয়েছেন কর্মীরা। এবারের আগুনের ঘটনাস্থল লোকালয় থেকে দূরে বলে নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু হয়েছে দেরিতে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক আবদুস সোবহান মল্লিক গত ফেব্রুয়ারিতে একটি দল নিয়ে পূর্ব সুন্দরবন অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন। ‘সমন্বিত বন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার’ অংশ হিসেবে এই মাঠপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি আজ রোববার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগুনের সূত্রপাত হলে প্রথম জরুরি কাজ ফায়ার লাইন তৈরি করা। এ কাজটি সবচেয়ে দ্রুত ও দক্ষভাবে করতে পারবেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাই ফায়ার লাইন করতে তাঁদের সম্পৃক্ত করতে হবে।’
আবদুস সোবহান মল্লিক বলেন, ‘বনের ভেতর ছোট ছোট খাল থাকায় আমাদের অঞ্চলে সুন্দরবনে দাবানলের মতো আগুন ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কিছুটা কম। অধিকাংশ ঘটনায় দেখা যায়, বড় গাছ অপেক্ষা ঝোপের মতো জায়গায় আগুন বেশি লাগে।’ আগুনে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক মাত্রা নিরূপণে জীববৈচিত্র্য কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী, সেটাও ক্ষয়ক্ষতির হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা খুবই জরুরি বলে মনে করেন আবদুস সোবহান মল্লিক।