৬১% রোগীর চিকিৎসা দেন ওঝারা

প্রাণ বাঁচাতে অ্যান্টিভেনাম দরকার হয়। সব হাসপাতালে সাপে কামড়ানো রোগীর চিকিৎসায় তা নেই।

পাটখেতে কাজ করার সময় গত ৩ জুলাই রাজবাড়ীর কৃষক জাহিদ প্রামানিককে সাপে কামড়ায়। প্রথমে তিনি চিকিৎসার জন্য পাংশা সদর হাসপাতালে যান। সাপের বিষের চিকিৎসা না থাকায় তিনি বাসে চড়ে কুষ্টিয়ায় যান এবং সদর হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসকদের প্রচেষ্টায় তাঁর প্রাণরক্ষা হয়।

এর কিছুদিন আগে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার এক যুবক সদর হাসপাতালে এসে চিকিৎসা পাননি। কারণ, হাসপাতালে সাপে কামড়ানো রোগীর চিকিৎসার ওষুধ অ্যান্টিভেনাম ছিল না।

দেশে প্রায় প্রতিদিনই সাপের কামড়ের শিকার হচ্ছেন মানুষ। গ্রামে এসব ঘটনা বেশি। তবে উপজেলা পর্যায়ে সব হাসপাতালে এসব রোগীর ওষুধ নেই। ঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। গবেষকেরা বলছেন, সাপের কামড়ের ৬১ শতাংশ রোগী চিকিৎসা নেন ওঝাদের কাছ থেকে।

দুই মাস আগেই আমরা প্রতিটি জেলার কাছে ওষুধের চাহিদা জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। যেসব জেলা চাহিদাপত্র দিয়েছে, আমরা তাদের অ্যান্টিভেনাম সরবরাহ করেছি। যারা চাহিদা দেয়নি, তাদের হাসপাতালে এই ওষুধ নেই।
অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক রোবেদ আমিন

 শুক্রবার ৯টি জেলা ও ১৮টি উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি সব হাসপাতালে সাপে কামড়ানো রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে না। অ্যান্টিভেনাম সব উপজেলার হাসপাতালে নেই। এমনকি বাগেরহাট জেলা সদর হাসপাতালেও এই ওষুধ নেই। জেলার সিভিল সার্জন জালাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, জেলার কোনো হাসপাতালে সাপে কামড়ানো রোগীর চিকিৎসার ওষুধ অ্যান্টিভেনাম নেই।

দেশের সব জেলা ও উপজেলা সদর সরকারি হাসপাতালে অ্যান্টিভেনাম থাকার কথা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর চার লাখ তিন হাজারের বেশি মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন। এর মধ্যে মারা যান সাড়ে সাত হাজারের বেশি মানুষ। গত মাসে রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলে এই গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়।

জরিপে দেখা গেছে, সাপের কামড়ের ৯৫ শতাংশ ঘটনা ঘটে গ্রামে। নারীর চেয়ে পুরুষের মধ্যে সাপের কামড়ের হার বেশি। অন্যদিকে ৩৫–৪৪ বছর বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি।

মাঠের পরিস্থিতি

কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর ও চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, বাগেরহাট জেলার মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জে, খুলনা জেলার দাকোপ ও বটিয়াঘাটা এবং বরগুনা জেলার আমতলী ও পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, এসব হাসপাতালে সাপে কামড়ানো রোগীর ওষুধ নেই। কোনো রোগী এলে তারা সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। বাগেরহাট জেলার কর্মকর্তারা বলেছেন, কোনো রোগী এলে তাঁরা পার্শ্ববর্তী জেলা খুলনায় রোগী পাঠানোর পরামর্শ দেন।

অন্যদিকে সুনামগঞ্জ, পটুয়াখালী ও খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অ্যান্টিভেনাম আছে। ঠাকুরগাঁও জেলা সদর হাসপাতালে সম্প্রতি ১০০ ভায়াল অ্যান্টিভেনাম দেওয়া হয়েছে।

অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক রোবেদ আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই মাস আগেই আমরা প্রতিটি জেলার কাছে ওষুধের চাহিদা জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। যেসব জেলা চাহিদাপত্র দিয়েছে, আমরা তাদের অ্যান্টিভেনাম সরবরাহ করেছি। যারা চাহিদা দেয়নি, তাদের হাসপাতালে এই ওষুধ নেই।’

গত তিন মাসে চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে সাপের কামড়ের শিকার ৪১৭ ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছেন, এর মধ্যে মারা গেছেন দুজন। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১০১ জন এবং পটুয়াখালী সদর ও বিভিন্ন উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৫৭ জন।

সর্প দংশনের সমস্যাকে জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার। ওঝাদের চিকিৎসাকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। পাশাপাশি অ্যান্টিভেনাম সহজলভ্য করার জন্য দেশেই এই ওষুধ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এম এ ফয়েজ

গবেষকেরা কী দেখেছেন

সাপের কামড়ের পরিস্থিতি জানার জন্য অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার অর্থায়নে ২০২১ সালে একটি জাতীয় জরিপ হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ এবং অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা যৌথভাবে এই জরিপ করে। জরিপে ৬৪ জেলার ৬৫ হাজার ৯২৭ জনের তথ্য নেওয়া হয়।

জরিপে দেখা গেছে, সাপের কামড়ের ৯৫ শতাংশ ঘটনা ঘটে গ্রামে। নারীর চেয়ে পুরুষের মধ্যে সাপের কামড়ের হার বেশি। অন্যদিকে ৩৫–৪৪ বছর বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি।

জরিপে দেখা গেছে, খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে বেশি মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন। এরপর এই হার বেশি বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে। বিভিন্ন পেশার মধ্যে গৃহিণীরাই সবচেয়ে বেশি ঘটনার শিকার হন। এরপর আছেন কৃষকেরা।

সাপে কামড়ালে অনেকে ভীত হয়ে পড়েন, দ্রুত চিকিৎসা পেতে চান। জরিপে দেখা গেছে, ৬১ শতাংশ রোগী চিকিৎসা নেন ওঝাদের কাছ থেকে। প্রশিক্ষিত ও দক্ষ চিকিৎসকদের কাছ থেকে চিকিৎসা নেন ৩৫ শতাংশ রোগী। বাকি ৪ শতাংশ যান অদক্ষ চিকিৎসা সেবাদানকারী ব্যক্তিদের কাছে।

এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এম এ ফয়েজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সর্প দংশনের সমস্যাকে জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার। ওঝাদের চিকিৎসাকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। পাশাপাশি অ্যান্টিভেনাম সহজলভ্য করার জন্য দেশেই এই ওষুধ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর আঞ্চলিক প্রতিনিধিরা]