অ্যাসিড প্রতিরোধ

নজর নেই, বাড়ছে অ্যাসিড সহিংসতা 

২০০২ সালে আইন প্রণয়নের পর অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা কমেছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ ও নজরদারির দুর্বলতায় গত বছর আবার বেড়েছে অ্যাসিড সহিংসতা। 

‘ঘরের বাইরে যেতে অস্বস্তি লাগে। সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।’ এই প্রতিবেদককে এভাবে কষ্টের কথা বললেন মো. আসাদ মন্ডল (২০)। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র তিনি। অ্যাসিডদগ্ধ হওয়ার দুদিন আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

গত ১২ জানুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে আসাদের খালার বাসায় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। চিকিৎসক দেখাতে বাবার সঙ্গে গাইবান্ধা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। অ্যাসিডে তাঁর মাথা ও মুখের ডান পাশ, ঘাড়, পিঠ, বুক ও হাত দগ্ধ হয়। চোখের পাতা পুড়ে যাওয়ায় চোখ বন্ধ করতে কষ্ট হয়। ঠোঁট পুরোপুরি দগ্ধ।

মামলা সূত্রে জানা যায়, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ঘুমন্ত আসাদের ওপর চাচা–চাচি অ্যাসিড ছোড়েন। ওই সময় পাশে ঘুমন্ত তাঁর ছোট ভাই আসিব মন্ডলও (১৪) দগ্ধ হয়।

অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) তথ্যমতে, ২০২২ সালে অ্যাসিড সহিংসতার ১৭টি ঘটনায় ২৭ জন দগ্ধ হন। এর মধ্যে ১৬ নারী, ৯ পুরুষ এবং দুই শিশু রয়েছে। এই হিসাব বলছে, অ্যাসিড সহিংসতা বাড়তির দিকে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যাসিড সহিংসতা কমেছে—নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এমন ‘আত্মতুষ্টি’র কারণে আইনের প্রয়োগ ও নজরদারি দুর্বল হয়ে পড়েছে। অ্যাসিড দমন আইনের মামলায় দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে না পুলিশ। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের হাতে কীভাবে অ্যাসিড যাচ্ছে, সেটা অনুসন্ধানের বাইরে থেকে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগও কমে গেছে।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অ্যাসিড সহিংসতার নতুন কোনো ঘটনা আমার জানা নেই।’ গত বছর ২৭ জন দগ্ধের তথ্য জানালে তিনি বলেন, ‘আগে দিনে ৩–৪টি ঘটত, এখন বছরে ২৭টিতে নেমে এসেছে।’ অ্যাসিড–সংক্রান্ত মামলার তদন্তে পুলিশের গাফিলতির বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এগুলো আমাকে দেখে বলতে হবে।’

অ্যাসিড সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রচার ও অ্যাসিডদগ্ধ ব্যক্তিদের সহায়তায় ২০০০ সাল থেকে প্রথম আলো কাজ করছে। ওই সময় প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এক দিনের বেতন দিয়ে একটি তহবিল গঠন করেছিলেন। পরে এই তহবিলে সমাজের নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ অংশ নেন। এএসএফ ও ব্র্যাকের সঙ্গেও কাজ করেছে প্রথম আলো। ২০০৯ সাল থেকে প্রথম আলো ট্রাস্টের মাধ্যমে অ্যাসিডদগ্ধ ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ চলছে। এ পর্যন্ত ৪৫৭ অ্যাসিডদগ্ধ ব্যক্তিকে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, ভূমিহীনদের বাড়ি, শিক্ষা, আইনি, চিকিৎসা ও মাসিক ভাতা দেওয়া হয়।

সহিংসতার কারণ

কয়েক বছরের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের কারণে সবচেয়ে বেশি অ্যাসিড সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ২০০৬ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে (২০১২ সাল বাদে) অ্যাসিড সহিংসতার অর্ধেক ঘটনাই ঘটেছে জমিজমা নিয়ে বিরোধের জেরে। ২০১৫ সাল থেকে এ ঘটনা এক–চর্তুথাংশে নেমে আসে। ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে তা ২০ শতাংশের নিচে নেমে আসে।

২০২২ সালে জমিজমা নিয়ে বিরোধ ও প্রতিবেশীর অনৈতিক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সর্বোচ্চ পাঁচটি ঘটনা ঘটেছে। যৌতুক নিয়ে স্বামীর মাধ্যমে চারটি, সাবেক স্বামীর মাধ্যমে একটি, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের মাধ্যমে একটি, সাবেক প্রেমিকের মাধ্যমে একটি এবং স্বজন, পারিবারিক বন্ধু, পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে বাকি পাঁচটি ঘটনা ঘটেছে। দগ্ধ ব্যক্তিদের ৫৯ শতাংশই নারী।

এএসএফের নির্বাহী পরিচালক সরদার জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অ্যাসিড সহিংসতা কমেছে ভেবে নীতিনির্ধারক থেকে গণমাধ্যম—সব পর্যায়ে একধরনের ঢিলেঢালা ভাব দেখা যাচ্ছে। অ্যাসিড বিক্রি এবং সহিংসতা কমাতে সচেতনতা সৃষ্টির ওপর নজরদারির দুর্বলতায় সহিংসতা আবার বাড়তে পারে। 

২৪ বছরে দগ্ধ ৩৮৭০

এএসএফ ১৯৯৯ সাল থেকে অ্যাসিড সহিংসতার পরিসংখ্যান রাখছে। সংস্থাটির তথ্যমতে, ১৯৯৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে ৩ হাজার ৮৭০ জন অ্যাসিডদগ্ধ হন। ১৯৯৯ সালে ১৬৮ জন অ্যাসিডের শিকার হন। ২০০২ সালে সর্বোচ্চ ৪৯৬ জন দগ্ধ হন। ২০০৩ সাল থেকে অ্যাসিডদগ্ধ ব্যক্তির সংখ্যা কমতে শুরু করে। ২০১৮ সালে ২২, ২০১৯ সালে ২১, ২০২০ সালে ২২, ২০২১ সালে ১৯ এবং ২০২২ সালে বেড়ে ২৭ জন হয়েছে। 

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক তানভীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আগুন বা গরম পানিতে পোড়া রোগীদের ক্ষত ধীরে ধীরে সেরে ওঠে। কিন্তু অ্যাসিডে পোড়ার ক্ষত অনেক গভীর হয়। নিচের চামড়া এমনভাবে পোড়ে যে ঠিক করা যায় না। পাঁচ–ছয় বছর চিকিৎসা চালাতে হয়।

বাবার সঙ্গে চাচার দ্বন্দ্ব, শিকার আসাদ

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের উত্তর শাহবাজ গ্রামে আসাদের বাড়ি। তিনি বলেন, দাদার জমি বিক্রির ৪৬ লাখ টাকার ভাগ–বাঁটোয়ারা ও সম্পদ নিয়ে বিরোধের জেরে তাঁকে মধ্যরাতে অ্যাসিড ছোড়া হয়।

ঘটনার এক দিন পর ৩০ সেপ্টেম্বর আসাদের মা আনোয়ারা বেগম তাঁর দুই ছেলেকে অ্যাসিড ছোড়ার ঘটনায় আসাদের চাচা রাশেদুল ইসলাম (৩২), চাচি মুক্তা বেগম (২৮) এবং চাচির ভাই মেহেদী হাসানকে (৩০) আসামি করে অ্যাসিড অপরাধ দমন আইনে মামলা করেন। পুলিশ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে। চাচি আত্মসমর্পণ করে জামিনে, বাকি দুজন পলাতক।

আসামিদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে সুন্দরগঞ্জ থানার বামনডাঙ্গা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত শফিকুজ্জামান সরকার প্রথম আলোকে বলেন, আসামিরা মুঠোফোন ব্যবহার করে না। তাই তাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না।

নাসরিনের অভিযোগ স্বামীর বিরুদ্ধে

নাসরিন বেগমের (৪৫) বাড়ি ঝালকাঠির শেখেরহাট ইউনিয়নের রাজপাশা গ্রামে। তাঁর ভাবি তাসলিমা বেগম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, নাসরিন স্বামী মো. ফারুকের সঙ্গে গাজীপুরের মাওনায় থাকতেন। তিনি আরেকটা বিয়ে করতে চাইলে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। গত বছরের ১৮ মার্চ স্বামী তাঁকে অ্যাসিড মারেন।

নাসরিন অভিযোগ করেন, তিনি ঝালকাঠিতে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করলেও পুলিশের কোনো তৎপরতা নেই।

তবে বরিশাল পুলিশ ব্যুারো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনা গাজীপুরের। ভুক্তভোগীকে সেখানে মামলা করতে হবে।

তবে গাজীপুরে গিয়ে মামলা করার মতো তাঁদের কাছে অর্থ নেই বলে জানান তাসলিমা।

নাসরিনের স্বামীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

সমাজের মধ্য থেকে প্রতিরোধ হতে হবে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অ্যাসিড সহিংসতা কমে গেছে বলে এটাকে গুরুত্বের বাইরে রাখা যাবে না। বরং এ অপরাধ এখনো কেন ঘটছে, সেটার গুরুত্ব বুঝে তা পুরোপুরি বন্ধে গবেষণা করা দরকার। এ অপরাধ প্রতিরোধে সমাজে সমন্বিত ব্যবস্থা গড়তে হবে।