কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী তৃণমূল মঞ্চ’-এর ব্যানারে গণসমাবেশ করেন অপসারিত কাউন্সিলরদের একাংশ
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী তৃণমূল মঞ্চ’-এর ব্যানারে গণসমাবেশ করেন অপসারিত কাউন্সিলরদের একাংশ

অপসারিত কাউন্সিলরদের একাংশের সমাবেশ

সার্চ কমিটি করে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের স্থানীয় সরকারে প্রশাসক নিয়োগের দাবি

সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে সমাজের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি এবং যাঁদের ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের’ দীর্ঘ ইতিহাস আছে, তাঁদের স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অপসারিত সিটি ও পৌর কাউন্সিলরদের একাংশ। এটিসহ তিন দফা দাবিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন তাঁরা।

মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী তৃণমূল মঞ্চ’-এর ব্যানারে গণসমাবেশ করেন কাউন্সিলরদের একাংশ। ‘জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যার দায়ে খুনি হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচার এবং স্থানীয় সরকারে প্রতিনিধি নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটি গঠনের দাবিতে গণসমাবেশ’ শীর্ষক এই কর্মসূচির পর তাঁদের চার সদস্যের প্রতিনিধিদল সচিবালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি জমা দেয়।

সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা আওয়ামী লীগবিরোধী কাউন্সিলরদের পুনর্বহাল দাবি করেন। জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী তাঁদের রাজনৈতিক দল গঠনে অপসারিত কাউন্সিলরদের সহায়তা চাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। এরপর জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের উদ্যোগেই ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী তৃণমূল মঞ্চ’ নামে নতুন প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করা হয়। এর সভাপতি সিটি করপোরেশন কাউন্সিলর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নজরুল ইসলাম খান। সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য আলাউদ্দীন মোহাম্মদ। আর সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সংগঠক আলী নাছের খান।

শহীদ মিনারে গণসমাবেশে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা ১৭ বছর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। এই মঞ্চ থেকে খুনি হাসিনার বিচার দাবি করছি। তাঁকে ভারত থেকে এনে ফাঁসিতে ঝোলানোর অনুরোধ জানাই। ...বর্তমান সরকার আমাদের আন্দোলনের ফসল। এই সরকারকে আমরা সমর্থন করব। সরকার আমাদের (কাউন্সিলর) অপসারণ করেছে। কিন্তু নৌকা প্রতীকের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা এখনো বহাল তবিয়তে আছে। সরকারের কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ, একটা সার্চ কমিটি করে তার মাধ্যমে প্রত্যেকটি এলাকায় যাঁরা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যাঁরা জনদুর্ভোগ লাঘব করতে পারবেন, এ ধরনের লোকদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করে জনসেবা করার সুযোগ দিন।’

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর মোসাম্মৎ আয়েশা আক্তার বলেন, ‘আমরা ১৭ বছর নির্যাতিত হয়েছি। তারপরও জনগণকে সেবা দেওয়ার জন্য নিজের ভিটা-বাড়ি বিক্রি করে বারবার নির্বাচন করেছি। আমি যেখানে কাউন্সিলর হয়েছি, সেখানে আন্তর্জাতিক গডফাদার শামীম ওসমানের বসবাস ছিল। সেখানে শামীম ওসমানের প্রার্থীকে বারবার হারিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছি। আমার জনপ্রিয়তার জন্য বারবার আমাকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল। আমি বলেছি, ফাঁসি দিলেও আওয়ামী লীগে যোগ দেব না। ...অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় শামীম ওসমানের নির্দেশে আমার ওপর পুলিশ নির্মম নির্যাতন করেছিল। সেই নির্যাতনে আমার গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এরপরও মামলা-নির্যাতন সহ্য করেছি। ওই ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আমরা সব সময় লড়ে গিয়েছি। মানুষের সেবা করেছি। আমরা ছিলাম বলেই জনগণ সাহস পেয়েছিল, প্রতিবাদ করতে পেরেছিল।’

সমাবেশে আলাউদ্দীন মোহাম্মদ বলেন, ‘৫ আগস্টের পর সব কাউন্সিলর ও জনপ্রতিনিধিকে অপসারণের সরকারি সিদ্ধান্তকে আমরা প্রাথমিকভাবে সাধুবাদ জানাই৷ কিন্তু সরকার এটা হরেদরে সবার ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না।’ তিনি বলেন, সরকারকে এখন একটি সার্চ কমিটি গঠন করতে হবে। সেই কমিটির মাধ্যমে এই জনপ্রতিনিধিরা গত ১৫ বছরে কারা কীভাবে জনগণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কারা কীভাবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন কিংবা ফ্যাসিবাদের অবস্থান নিয়ে গুম-খুন-গণহত্যার রাজনীতি সমর্থন দিয়েছিলেন, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। সার্চ কমিটির মাধ্যমে সরকারকে দেখতে হবে, কারা জনগণের বন্ধু, কাদের জনভিত্তি বা জনসমর্থন আছে। তাঁদের প্রশাসক হিসেবে বা অন্য কোনো উপায় থাকলে সেই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দিতে হবে৷

উপস্থিত অপসারিত কাউন্সিলরদের উদ্দেশে আলাউদ্দীন বলেন, ‘আপনাদের সম্মানিত সভাপতি নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে আলোচনা করে তিনটি দাবি নিয়ে আমরা মাননীয় উপদেষ্টার কার্যালয়ে যাবো।’ তিনি দাবি তুলে ধরে বলেন, প্রথমত, বিগত আওয়ামী ফ্যাসিবাদী জমানায় যেসব কাউন্সিলর গণহত্যা, গুম-খুন, লুটপাট ও দুর্নীতি করেছে, যাঁরা এখন পলাতক; সেই অপরাধী কাউন্সিলরদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে সমাজের গণমাণ্য ব্যক্তি, স্কুলের শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও স্থানীয় পর্যায়ের সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি এবং যাঁদের ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, তাঁদের স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। তৃতীয়ত, স্থানীয় প্রশাসনের দলীয়করণ বন্ধ করে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় নাগরিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।

কাউন্সিলর অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী গোলাম কিবরিয়া সমাবেশ সঞ্চালনা করেন। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও এবি পার্টির নেতা আসাদুজ্জামান ফুয়াদও এতে বক্তব্য দেন। পরে স্মারকলিপি নিয়ে সচিবালয়ে যান ফ্যাসিবাদবিরোধী তৃণমূল মঞ্চের চারজন প্রতিনিধি। তাঁরা হলেন নজরুল ইসলাম খান, কাজী গোলাম কিবরিয়া, আলাউদ্দীন মোহাম্মদ ও আলী নাছের খান৷ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নজরুল ইসলামের হাতে তাঁরা স্মারকলিপি তুলে দেন৷