মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি গত বছর ডেঙ্গুতে দুই ছেলে-মেয়ে হারিয়েছেন। সম্প্রতি তাঁরা এক ছেলেসন্তানের বাবা–মা হয়েছেন
মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি গত বছর ডেঙ্গুতে দুই ছেলে-মেয়ে হারিয়েছেন। সম্প্রতি তাঁরা এক ছেলেসন্তানের বাবা–মা হয়েছেন

ডেঙ্গুতে দুই ছেলে-মেয়ে হারানো দম্পতির ঘর আলো করে এসেছে এক সন্তান

এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডেঙ্গুতে দুই ছেলে-মেয়ে হারানো মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতির ঘর আলো করে এক ছেলেসন্তান এসেছে।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ১৮ আগস্ট এই দম্পতির ছেলে আরাফাত হোসেন রাউফ মারা যায়। ২৫ আগস্ট মারা যায় মেয়ে ইসনাত জাহান রাইদা। আরাফাতের বয়স ছিল ৯ বছর, রাইদার সাড়ে ৬ বছর।

দুই ছেলে-মেয়েকে হারিয়ে ইব্রাহিম-রাবেয়া দম্পতি পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা এখনো দুই সন্তান হারানোর শোকের মধ্যে আছেন। এই শোক আজীবনই থাকবে।

তবে জীবন থেমে থাকে না। গত ২৩ মে এই দম্পতি এক ছেলেসন্তানের বাবা-মা হয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার রাতে মুঠোফোনে কথা হয় ইব্রাহিমের সঙ্গে। তিনিই ছেলেসন্তানের বাবা হওয়ার খবরটি দিলেন। তারপরই তাঁর কণ্ঠ ধরে আসে।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ১৮ আগস্ট আরাফাত হোসেন রাউফ মারা যায়। ২৫ আগস্ট মারা যায় ইসনাত জাহান রাইদা

ইব্রাহিম বললেন, ‘আল্লাহ আমাদের একটি ছেলেসন্তান দিয়েছেন। আমার স্ত্রী এখন আগের চেয়ে কিছুটা ভালো আছেন। কিন্তু দুই ছেলে-মেয়ের কথা তো আমরা ভুলতে পারি না। এবার ঈদুল আজহায় আমরা কোরবানি দিয়েছি। আমার ছেলে আরাফাত কোরবানি দেওয়া খুব পছন্দ করত। ঘুরে ঘুরে গরু দেখত। এবার তো আর সেসবের কিছুই হলো না।’

গত বছরের ৩১ আগস্ট প্রথম আলো অনলাইনে ‘ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহের মধ্যে দুই ছেলে-মেয়েকেই হারালেন এই বাবা-মা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।

আরাফাত ও রাইদা মা–বাবার সঙ্গে প্রতি শুক্রবার বাইরে ঘুরতে যাওয়ার, মজার মজার খাবার খাওয়ার অপেক্ষায় থাকত। ইব্রাহিম চেষ্টা করতেন, প্রতি শুক্রবার পরিবার নিয়ে বাইরে ঘুরতে যেতে। বাড়ি ফিরে ঘোরাঘুরির ছবি ফেসবুকে পোস্ট করতেন। তিনি বললেন, ‘এখন আর শুক্রবারের জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকে না। সেভাবে আর ছবিও তোলা হয় না।’

দুই ছেলে-মেয়েকে হারিয়ে ইব্রাহিম-রাবেয়া দম্পতি পাগলপ্রায় হয়ে যান

গত বছরের আগস্টের মাঝামাঝি এই দম্পতি আরাফাত-রাইদাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলেন। দুই সন্তানের সঙ্গে সেদিনই তাঁরা শেষ ছবি তুলেছিলেন।

ইব্রাহিম জানালেন, প্রায় এক মাস আগে তিনি এক ছেলেসন্তানের বাবা হয়েছেন। নাম রেখেছেন ইসমাইল রাইসি। এই ছেলের সঙ্গে এখন পর্যন্ত মাত্র একটি ছবি তুলেছেন তাঁরা।

ইব্রাহিম বললেন, ‘ছেলে বাবুর বাবা হইছি। অস্ত্রোপচার লাগেনি। স্বাভাবিকভাবেই ওর জন্ম হইছে। এবারও কোরবানি দিছি। আরাফাতের গরুর মাংস খুব প্রিয় ছিল। আমরা স্বামী-স্ত্রী ঈদের দিন কান্নাকাটি করেই দিন পার করেছি।’

ইব্রাহিম-রাবেয়া দম্পতি রাজধানীর মধ্য পাইকপাড়ার ছাপাখানা মোড়ে থাকতেন। পাইকপাড়ায় আইকন একাডেমি নামের একটি স্কুলে আরাফাত কেজিতে আর রাইদা নার্সারিতে পড়ত। সেখানকার ভাড়াবাসায় দুই ছেলে-মেয়ের বিভিন্ন স্মৃতি প্রতি মুহূর্তে তাঁদের চোখে ভেসে উঠত। তাঁরা অনেক কষ্ট পাচ্ছিলেন। তাই তাঁরা পাইকপাড়াতেই আরেকটি বাসা ভাড়া নিয়েছেন।

সাভারের হেমায়েতপুরে দুই ছেলে-মেয়েকে পাশাপাশি কবর দিয়েছেন বলে জানান ইব্রাহিম। সময় পেলেই স্বামী-স্ত্রী সেখানে চলে যান।

আরাফাত হোসেন রাউফ আর ইসনাত জাহান রাইদা এখন কেবলই স্মৃতি

ডেঙ্গুতে এখনো মানুষ মারা যাচ্ছে—এ প্রসঙ্গে রেন্ট-এ-কার ব্যবসায়ী ইব্রাহিম বলেন, ‘বাসা পাল্টাইছি। কিন্তু পুরো এলাকার পরিবেশই তো নোংরা। মশাও আছে। ভয় লাগে। কিন্তু কিছু তো করার নাই। এসব কথা কাকে বলব? বলেই-বা কী লাভ? চাপানো কষ্ট আরও বাড়ে। আমাদের মনের যে কষ্ট, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না।’

ইব্রাহিম জানালেন, গত বছরের ১৪ আগস্ট আরাফাতের হালকা জ্বর আসে। ১৫ আগস্ট এলাকার এক চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়। ১৬ আগস্ট রক্ত পরীক্ষায় আরাফাতের ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। প্লাটিলেট ভালো থাকায় চিকিৎসক বলেছিলেন, হাসপাতালে নেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু পরের দিন ১৭ আগস্ট আরাফাতের প্লাটিলেট দ্রুত কমতে থাকে। ১৮ আগস্ট হাসপাতালে ভর্তি করার আগেই আরাফাত মারা যায়।

ধানমন্ডির একটি হাসপাতালের শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (পিআইসিইউ) মেয়ে রাইদা পাঁচ দিন ভর্তি ছিল বলে জানান ইব্রাহিম। তিনি বলেন, মেয়ে ভালো আছে বলে তখন চিকিৎসকেরা তাকে বাসায় নিতে বলেছিলেন। তবে মেয়েকে বাসায় আনার পরই আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন মহাখালীর আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালের পিআইসিইউতে মেয়েকে ভর্তি করা হয়। ২৫ আগস্ট সকালে মেয়ে মারা যায়।

মশা নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে ইব্রাহিম বলেন, বুক খালি হওয়া বাবা-মায়েদের কষ্টটা একটু অনুভব করে হলেও যাতে সংশ্লিষ্ট সবাই মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হয়।

ইব্রাহিম হেমায়েতপুরে একটি জায়গা কিনেছিলেন। সেখানে বাড়ি করে মেয়ে রাইদার কক্ষটি গোলাপি আর ছেলে আরাফাতের কক্ষ নীল রং দিয়ে সাজাতে চেয়েছিলেন।

আরাফাতকে ‘বড় কলিজা’ আর রাইদাকে ‘ছোট কলিজা’ বলে ডাকতেন ইব্রাহিম। তিনি বলেন, আরাফাত-রাইদার জন্য তো আর সেই ঘর বানিয়ে কক্ষ সাজানোর স্বপ্ন পূরণ হবে না। এখন ছেলে ইসমাইলকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেও ভয় পান ইব্রাহিম-রাবেয়া দম্পতি।