বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য দেন। ঢাকা, ১১ নভেম্বর
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য দেন। ঢাকা, ১১ নভেম্বর

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

‘ফ্যাসিবাদের দোসরদের’ উপদেষ্টা পরিষদ থেকে সরানোর দাবি

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ রয়েছেন বলে মনে করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের দাবি, উপদেষ্টাদের মধ্যে যাঁরা ‘সফট আওয়ামী লীগার’ বা ফ্যাসিস্ট দলের প্রতি সহানুভূতিশীল, অবিলম্বে তাঁদের সরিয়ে দিতে হবে। ছাত্র-জনতার অংশীদারত্বের বাইরে গিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সেটি মেনে নেবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

‘ছাত্র-জনতার অংশীদারত্ববিহীন সিদ্ধান্তে উপদেষ্টা নিয়োগের’ প্রতিবাদে সোমবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কাছাকাছি সময়ে প্রায় একই বিষয়ে একই জায়গায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে মানববন্ধনের পৃথক কর্মসূচি ছিল। পরে দুটি কর্মসূচি যৌথভাবে পালন করা হয়।

ফ্যাসিবাদের ‘দোসরদের’ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের প্রতিবাদে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী ও যশোরে সোমবার বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল হয়েছে।

ঢাকার বিক্ষোভ সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, শিক্ষার্থীরা যখন আওয়ামী দোসরদের তাড়াতে ব্যস্ত, ঠিক তখন খবর আসে, নতুন করে উপদেষ্টা নিয়োগ (রোববার সন্ধ্যায়) দেওয়া হচ্ছে। যাঁরা ধানমন্ডি ৩২-কে ‘কাফেলা’ মনে করেন, তাঁদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থী, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের রক্তকে পুঁজি করে যদি কেউ ভেবে থাকেন তাঁরা উপদেষ্টা হবেন, পদ বাগিয়ে নেবেন, তাহলে তাঁরা ভুল ভাবছেন। কাদের ‘প্রেসক্রিপশনে’ আওয়ামী দোসরদের পুনর্বাসন হচ্ছে, সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।

হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘যে শিক্ষার্থী ও শ্রমিকেরা নিজেদের তাজা রক্ত রাস্তায় ঢেলে দিয়ে এই গণ–অভ্যুত্থান সফল করেছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা না করে, তাঁদের অংশীদারত্ব নিশ্চিত না করে আপনারা কাদের পুনর্বাসনের ম্যান্ডেট নিয়েছেন? শিক্ষার্থী, নাগরিক, শ্রমিক-জনতার সঙ্গে মশকরা বন্ধ করুন। ফ্যাসিবাদের সব প্রতীক, বৃত্তি, ল্যাস্পেন্সার (সহযোগী), উত্তরসূরি—আমরা সবকিছুরই রিমুভাল (অপসারণ) চাই।’

সরকারকে বাঁচানোর জন্য শিক্ষার্থীরা আর আসবেন না উল্লেখ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই আহ্বায়ক বলেন, ‘আপনারা বিপদে পড়বেন, আওয়ামী পুনর্বাসন হবে আর আপনারা বললে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসবে, এটি আর বেশি দিন থাকবে না। ফ্যাসিবাদের যারা দোসর, ফ্যাসিবাদের সঙ্গে যাদের দূরতম সম্পর্ক আছে, গত ১৬ বছর ফ্যাসিবাদের নুন খেয়ে যারা গুণ গেয়েছে, ’২৪-পরবর্তী বাংলাদেশে কোনো ফরম্যাটেই আমরা তাদের পুনর্বাসন দেখতে চাই না। উপদেষ্টাদের স্পষ্ট করতে হবে, যাঁদের আপনারা নিয়োগ দিচ্ছেন, গত ১৬ বছরে তাঁদের অবদান কী।’

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আপনারা যদি মনে করে থাকেন আমাদের কণ্ঠরোধ বা প্রতিরোধ করবেন, ক্ষমতাকে প্রশস্ত করার জন্য বাধা মনে করলে আমাদের মাইনাস করে দেবেন, তাহলে আপনারা ভুল ভাবছেন। খুনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে আমরা উৎখাত করেছি তার লিগ্যাসি মেইনটেইন করার জন্য নয়।...ছাত্র-নাগরিকের অংশীদারত্বের বাইরে গিয়ে আপনারা যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তা মেনে নেওয়া হবে না এবং অতীতে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেগুলোর আমরা রিভিশন (পুনর্বিবেচনা) চাই। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, ছাত্র উপদেষ্টারা আমাদের হতাশ করবে না।’

বিক্ষোভ সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব আরিফ সোহেল বলেন, ‘আমাদের কাউকে বিন্দুমাত্র অবহিত না করে উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হলো।...এভাবে চলতে থাকলে নতুন আরেকটি সরকার তৈরি করতে আমাদের বিন্দুমাত্র সময় লাগবে না।’

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন যে গণ-অভ্যুত্থানে হয়, তার নেতৃত্বে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

‘সফট আওয়ামী লীগারদের’ সরানোর দাবি

যেসব ‘সফট আওয়ামী লীগারকে’ উপদেষ্টা পরিষদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের অবিলম্বে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ। তিনি বলেন, সর্বশেষ যাঁদের উপদেষ্টা করা হয়েছে, তাঁদের ব্যাপারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। এর আগে যাঁরা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁরা গত তিন মাসে কী কাজ করেছেন, তার শ্বেতপত্র জাতির সামনে প্রকাশ করতে হবে। কী কী সংস্কার হচ্ছে, কী কী উন্নতি হচ্ছে, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে তা বলতে হবে। মন্ত্রণালয়ের কী কী ডেভেলপমেন্ট (অগ্রগতি) হয়েছে, তা সংবাদমাধ্যমের সামনে এসে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার করে জাতিকে জানাতে হবে। দায়বদ্ধতা দেখাতে না পারলে উপদেষ্টার চেয়ার ছেড়ে দেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে আবদুল হান্নান মাসউদ বলেন, ‘আমরা আপনাদের এখন যেমন ওন (ধারণ করা) করি, আগামীকালকে ডিজওন করতেও আমরা দুবার ভাবব না। আপনারা যদি আমাদের কাছে জবাবদিহি না দেন, সেই চেয়ার থেকে নামাতেও আমরা দুবার ভাবব না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আপনাদের কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নেই।’

প্রয়োজনে লাল কার্ড

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা মাহিন সরকার বলেন, উপদেষ্টা নিয়োগে ছাত্র-জনতার মতের কোনো প্রতিফলন না থাকলে লাল কার্ড দেখানো হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। উপদেষ্টাদের মধ্যে যাঁরা ফ্যাসিবাদের দোসর, তাঁদের অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গকে বঞ্চিত করার সমালোচনা করেন তিনি।

নতুন উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সংস্কৃতির ‘কী বোঝেন’, সেই প্রশ্নও তোলেন মাহিন সরকার।

উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের পর থেকে গণ–অভ্যুত্থানের বিপ্লবী চেতনা ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করেন শিক্ষার্থী আহমদুল্লাহ নোমান। তাঁর মতে, রাতের ভোটে যেভাবে আগে সংসদ সদস্য নির্বাচন করা হতো, একই কায়দা উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে।

সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা তারিকুল ইসলাম, আবদুল কাদের, হাসিব আল ইসলাম প্রমুখ বক্তব্য দেন। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী বক্তব্য দেন। সমাবেশ শেষে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়।

‘সুবিধাভোগীরা ঢুকে যাচ্ছেন’

‘আওয়ামী সুবিধাভোগীদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসনের প্রতিবাদে’ বিক্ষোভ মিছিল করেছে ফ্যাসিবাদবিরোধী বিপ্লবী ছাত্র-জনতা। গতকাল বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ মিছিল মৎস্য ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়।

মিছিল শুরুর আগে সমাবেশে বক্তব্য দেন গণ অধিকার পরিষদের বিভিন্ন পদে থাকা নেতারা। তাঁরা বলেন, উপদেষ্টা পরিষদে আওয়ামী সুবিধাভোগীরা ঢুকে যাচ্ছেন। কয়েকজন উপদেষ্টার সমালোচনা করে বলা হয়, তাঁরা বিগত সরকারের সুবিধাভোগী। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করার দাবি জানান তাঁরা।