মুক্তিযুদ্ধের একদম অনালোচিত এক অধ্যায় তুলে ধরেছে নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান: দ্য শিলিগুড়ি কনফারেন্স: অ্যান আনটোল্ড স্টোরি অব দ্য লিবারেশন ওয়ার বইটি। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে যুদ্ধকৌশল ঠিক করা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখা এবং রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। এসবের সমাধানে ভারতের শিলিগুড়িতে সামরিক-বেসামরিক নেত্বত্ব ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কিছু ধূসর ও উজ্জ্বল দিকে নজর ফেলেছে শিলিগুড়ি সম্মেলনের ওপর একমাত্র বইটি। এ বিষয়ে দুই পর্বের আলোচনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান। আজ প্রথম পর্ব।
শিলিগুড়ি সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল, নিজেদের বিভিন্ন পক্ষের বিপরীতমুখী চিন্তার ব্যবধান কমিয়ে আনা।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকারের প্রতি মুক্তিফৌজের আস্থা নিশ্চিত করা।
স্বাধীনতা অর্জনের অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করা।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারকে কী ধরনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছিল, তারও কিছু দালিলিক প্রমাণ বইটিতে পাওয়া যাবে।
বইটি প্রকাশের আগপর্যন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন নিয়ে কোনো দলিল বা নথির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়নি।
যুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতির পর জনস্মৃতিতে আমরা প্রায়ই জড়িত নানা পক্ষের ভূমিকা সাদা-কালোর ব্যাখ্যায় নামিয়ে ফেলি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই প্রবণতা আরও প্রকটভাবে দেখা যায়। কেননা, বিজয়ের কৃতিত্বের দাবিদার বিভিন্ন পক্ষ যুদ্ধকালীন নানা অসন্তোষ, বিদ্রোহ, অভিযোগ, সিদ্ধান্তহীনতা কিংবা হতাশার বিষয়গুলোকে পরে আর আলাপযোগ্যই মনে করেনি।
এর স্পষ্ট কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় সুপরিচিত স্মৃতিকথাগুলোয়ও। সেসবে স্ববিরোধী, বিব্রতকর, মানহানিকর কিংবা হয়তো লজ্জাজনক বিষয়গুলোকে বোধ করি সচেতনভাবেই অতীতের কম প্রয়োজনীয় ঘটনা হিসেবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, মূলধারার তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধ গবেষকেরাও বিভিন্ন পক্ষের পরস্পরবিরোধী অবস্থান ও ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে অনাগ্রহী থেকে গেছেন।
অথচ যুদ্ধকে রাজনীতির অংশ হিসেবেই যদি ভাবা হয়, তাহলে যুদ্ধকালীন নানা পক্ষের অভ্যন্তরীণ দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর্যালোচনাকে ইতিহাস বিশ্লেষণের জরুরি উপায় হিসেবেই দেখার কথা। যেখানে যুদ্ধ মানেই লাখো-কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের বিষয়, সেখানে এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আর নানা উদ্যোগের দ্বান্দ্বিক জটিলতা এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। তা ছাড়া ব্যক্তিমানুষের দোদুল্যমানতা, স্বার্থ, সন্দেহ, অস্পষ্টতা কিংবা কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা রাজনৈতিক নেতাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না—এমন ভাবনা অনৈতিহাসিক।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখন কয়েক হাজার বইপত্রের খোঁজ সহজে পাওয়া গেলেও সেসবের অধিকাংশের মান ও গুরুত্ব নিয়ে চিন্তকসমাজের অসন্তোষ গোপন বিষয় নয়। বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-সাহিত্য যেন কানাগলিতে পৌঁছেছে, যেখানে বহুল পরিচিত তথ্যের চর্বিত চর্বণ করেই প্রতিবছর প্রচুর বাংলা বই প্রকাশিত হচ্ছে।
সেগুলোর সাফল্য অবশ্য যতটা না নতুন ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ বা তথ্যের উপস্থাপনের জন্য, তার চেয়েও বেশি বিশেষ বিবেচনায় সরকারি ক্রয় তালিকায় স্থান লাভের মধ্যেই যেন নিহিত। তার ওপর যুক্ত হয়েছে কথ্য এবং সামাজিক ইতিহাসের নামে অতিসাধারণ ও চিন্তাহীন প্রশ্নে জর্জরিত সাক্ষাৎকার–সংবলিত এবং কাঠামোবিহীন বইপত্রের বাহার।
তা ছাড়া যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নানা আঙ্গিকের আলাপের বৈশ্বিক ধারা থেকেও বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন রয়ে গেছে দেশীয় চর্চা। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় এই অচলাবস্থার পেছনে যেসব বাস্তব কারণ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত দলিলপত্র সংগ্রহে নিত্যনতুন উদ্যোগের অভাব। অভাবটা কেবল উদ্যোগের নয়, উৎসাহেরও।
বাংলাদেশের জাতীয় মহাফেজখানায় মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহের সক্রিয় উদ্যোগ না থাকার বিষয়টি হয়তো এর বাস্তব প্রমাণ। পরিস্থিতি যখন এ রকম, তখন যেকোনো অজানা অথচ গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্রের খোঁজ পাওয়া মানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আরও গভীরভাবে ভাবা ও জানার সুযোগ আসা।
তা ছাড়া নথিপত্রের গুরুত্ব কেবল নতুন তথ্য লাভের জন্য নয়, পুরোনো শোনা কথা কিংবা স্মৃতিকথায় প্রকাশিত তথ্যের সঠিকতা নির্ধারণের জন্যও সেগুলো প্রয়োজনীয় উৎস হতে পারে। সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ও মতিউর রহমান কর্তৃক সম্পাদিত ইংরেজি বই নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান: দ্য শিলিগুড়ি কনফারেন্স: গভর্নমেন্ট ইন এক্সাইল মিটস দ্য ইলেকটেড পিপলস রিপ্রেজেনটেটিভস: অ্যান আনটোল্ড স্টোরি অব দ্য লিবারেশন ওয়ার তেমন একটি আকরগ্রন্থ, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কিছু ধূসর দিক উন্মোচনে গবেষক ও পাঠকদের সাহায্য করবে।
বিশেষ করে, মুক্তিযুদ্ধকালীন আওয়ামী লীগের ইতিহাস উন্মোচনে বইটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে পারে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারকে কী ধরনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছিল, তারও কিছু দালিলিক প্রমাণ বইটিতে পাওয়া যাবে।
১৯৭১–এর জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে প্রধানত আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে ভারতের পশ্চিম বাংলার শিলিগুড়িতে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বইটির বিষয়বস্তু হলো যুদ্ধকালীন এই সম্মেলন বিষয়ে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কিছু নথি। প্রধানত চারটি অংশে বিভক্ত এই বইয়ের প্রথমেই রয়েছে সম্পাদকের নোট, যেখানে তিনি সংক্ষেপে নথিপত্রের বিষয়বস্তু নিয়ে পাঠককে ধারণা দিয়েছেন। দ্বিতীয় অংশে দেবাশীষ মিত্রের লেখা থেকে আমরা নথিপত্রগুলো উদ্ধারের কাহিনি জানতে পারি। তৃতীয় অংশে লে. কর্নেল (অব.) লুৎফুল হক ওই সম্মেলনের একটি বিস্তারিত প্রেক্ষাপট উপস্থাপন করেছেন এবং চতুর্থ অংশে নথিগুলো সংকলিত হয়েছে।
বিষয়টি এখন সুবিদিত যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে যে ‘প্রবাসী সরকার’ ১৯৭১ সালের এপ্রিলের ১০ তারিখে ভারত সরকারের পরামর্শে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল। [এইচ টি ইমাম (২০০৪), বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১। আগামী প্রকাশনী, ঢাকা। পৃ. ৭৮] বলা যায়, বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাদে সে সময় আওয়ামী লীগের অন্য কোনো নেতাই তাঁদের সহকর্মীদের কাছে সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকতে পারেননি।
প্রবাসী সরকারের নীতিনির্ধারণী ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিযোগিতা কিংবা ব্যক্তিত্বের নানা সংঘাত খোদ মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়েই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাঙালিদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার দুই মাসের মধ্যেই রাজনৈতিক অনুযোগ-অভিযোগ, আঞ্চলিকতা আর দলাদলি সামরিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছিল।
সম্পাদক মতিউর রহমান জানাচ্ছেন, এ রকম একটি প্রেক্ষাপটেই ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের একটি সম্মেলন আয়োজনের পরামর্শ দেয়, যেখানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন।
উদ্দেশ্য হলো, নিজেদের বিভিন্ন পক্ষের বিপরীতমুখী চিন্তার ব্যবধান কমিয়ে আনা এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকারের প্রতি মুক্তিফৌজের আস্থা নিশ্চিত করে স্বাধীনতা অর্জনের অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে, বিশেষ করে ৩৩তম কোরকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সম্মেলন আয়োজনের এবং তাদের সঙ্গে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সেসও (বিএসএফ) যুক্ত ছিল।
নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সদস্যরাসহ ৫-৬ জুলাই অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা। ব্রিগেডিয়ার অজিত কুমার মিত্র; যিনি ৩৩তম কোরের সদর দপ্তরের (প্রশাসন) ব্রিগেডিয়ার ইন চার্জ হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন; সম্মেলনটির আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
তাঁরই সন্তান, দেবাশীষ মিত্র, ২০০৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর ব্যক্তিগত কাগজপত্রের মধ্যে এই নথিপত্রের সন্ধান পেয়ে যান এবং বলা যায়, বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য সম্পাদক ও প্রকাশকের কাছে এই নথিগুলো প্রকাশের জন্য হস্তান্তরের মাধ্যমে তিনি বেশ উদার মনোভাবেরই পরিচয় দিয়েছেন।
অবশ্য তাঁর কিংবা সম্পাদকের বিবরণে স্পষ্ট হয়নি, আবিষ্কৃত হওয়ার এত দীর্ঘদিন পর কীভাবে তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল কিংবা নথিগুলোর মূল কপি এখন কোথায় সংরক্ষিত রয়েছে। যা–ই হোক, ৩৩তম কোরের সদর দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত লে. কর্নেল কে এ মজুমদারও এই সম্মেলন ব্যবস্থাপনায় যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া ক্যাপ্টেন এ ডি সুর্ভের উপস্থিতিও নথিপত্র থেকে জানা যায়, যিনি গোয়েন্দা (৬৪৭ ফিল্ড সিকিউরিটি সেকশন) সংস্থার হয়ে সম্মেলন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
সম্মেলন সম্পর্কে এই তিনজনের প্রতিবেদন নথিপত্রে স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে সম্মেলনে উপস্থাপিত মিজানুর রহমান চৌধুরীর একটি দীর্ঘ বিবৃতি এবং সর্বোপরি সম্মেলনের প্রথম গোপন অধিবেশনের কার্যবিবরণী; যেটি দিয়ে মূলত বইটির নথিপত্র অংশটি শুরু হয়েছে।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, বইটিতে সংকলিত নথিপত্রগুলো অসম্পূর্ণ। কারণ, সম্পাদকের তথ্যমতে, সবটা পাওয়া যায়নি। আসলে সম্মেলনের মূল প্রতিবেদনটিই উধাও। আরও পরিষ্কার করে বললে, দেবাশীষ মিত্র তাঁর বাবার ফাইলের মধ্যে যেটুকু পেয়েছিলেন, সেটুকুতে ইঙ্গিত রয়েছে যে মূল প্রতিবেদনটিতে আরও কিছু অংশ রয়েছে, যা পাওয়া যায়নি।
তা ছাড়া সম্মেলনে যে চার শতাধিক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়, তাঁদের নামের একটি প্রস্তুতকৃত তালিকাও একই কারণে এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তার পরও সংকলিত নথিপত্রগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ এই অর্থে যে এই বইটি প্রকাশের আগপর্যন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন নিয়ে কোনো দলিল বা নথির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়নি। এ ছাড়া সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিদের কেউ কেউ স্মৃতিকথা লিখে থাকলেও এই সম্মেলন সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো দালিলিক বিবরণ মেলে না। এসব দিক বিবেচনায় বইটির নথিপত্র মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের কাছে অত্যন্ত জরুরি বলেই মনে হবে।
বইটির তৃতীয় অংশে লে. কর্নেল (অব.) লুৎফুল হক একটি চমৎকার বিবরণ উপস্থাপন করেছেন যে কীভাবে ইতিমধ্যে প্রকাশিত নানা স্মৃতিকথায় ওই সম্মেলনের ইতিহাস উঠে এসেছে। যেমন সম্মেলনকে কেন্দ্র করে তাজউদ্দীন আহমদের বিরোধী আওয়ামী লীগের কিছু গ্রুপের বেশ সক্রিয় থাকার বিষয়টি আগে মঈদুল হাসানের বই কিংবা ফারুক আজিজ খানের স্মৃতিকথায় তোলা হয়েছিল।
জনাব হক একই সঙ্গে বইটিতে সংকলিত নথিপত্রে উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলোও এই অংশে তুলে ধরেছেন। অবশ্য সম্মেলনের সফলতা অর্জনের বিষয়ে তিনি যেভাবে উপসংহার টেনেছেন, তার সঙ্গে পুরোপুরি একমত হওয়া কঠিন। কারণ, সম্মেলনের পরও যুদ্ধকালীন নেতৃত্ব ও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল কিংবা অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধপন্থী দলের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ ঘটনা থেমে থাকেনি।
তবে জনাব লুৎফুল হকের লেখায় জুলাই সম্মেলনের আগের ও পরের ঘটনাবলি সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য যুক্ত হলে বইটি সম্পূর্ণতা পেত। যেমন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বা বিপক্ষে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন থাকা না-থাকা নিয়ে একাত্তর সালের এপ্রিল মাস থেকেই বিভিন্ন রকম সংবাদ পাকিস্তানে ও অধিকৃত বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিল।
আবার আগস্ট মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ের এই আলোচ্য সম্মেলনের পরেই আওয়ামী লীগ থেকে চলে আসা ৮৮ জন এমএনএর পদ ফিরিয়ে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের খবরও ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল ঢাকার পত্রপত্রিকায়। সন্দেহ, গুজব আর রটনার এসব ঘটনা দেখে মনে হবে, যুদ্ধের শুরুতেই নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের নেতাদের হৃদয় ও মন জয়ের লড়াইও চলমান ছিল পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষ থেকে।
পাকিস্তান সরকার, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানপন্থী অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল (বিশেষ করে পিডিপি) এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে এসব নিয়ে অঘোষিত এক প্রতিযোগিতা যেন শুরু হয়েছিল। পরিস্থিতির জটিলতা বুঝতে আমরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক) দপ্তরের গোপন পাক্ষিক প্রতিবেদনগুলোর দিকেও নজর দিতে পারি। (চলবে)