বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত এবং ব্রিটিশ আমল থেকেই ঐতিহ্যবাহী একটি জেলা ও প্রশাসনিক অঞ্চল ফরিদপুর। ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত জেলাটির নগরকান্দা উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের বাসিন্দা রুবিনা আক্তার (২৪)। পেশায় গৃহিণী রুবিনা সংসার সামলানোর পাশাপাশি বাড়িতে কাপড় সেলাইয়ের কাজও করেন। তাঁর স্বামী সুজন হোসেন প্রবাসী। রুবিনা আক্তার অনেক আগে থেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ইন্টারনেটে বিভিন্ন ভিডিও দেখেই একটু একটু করে সেলাইয়ের কাজ শিখেছেন তিনি। বর্তমানে প্রতিনিয়ত ইন্টারনেটে কাপড় কাটার নতুন ডিজাইন শিখে সেভাবে জামা-কাপড় তৈরি করছেন রুবিনা। হালের নিত্যনতুন ডিজাইন নিয়ে কাজ করার ফলে দিন দিন বাড়ছে তাঁর কাজের প্রচার ও প্রসার।
‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক প্রচারাভিযানের আওতায় সারা দেশের মতো ফরিদপুরেও হয়েছে উঠান বৈঠক। গ্রামীণ নারীদের ইন্টারনেট বিষয়ে জ্ঞান বাড়াতে গ্রামীণফোনের উদ্যোগটি ফরিদপুরে শুরু হয়েছিল গত ২৯ সেপ্টেম্বর। এ জেলার ৯টি উপজেলার ৫৬টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৩ নভেম্বর নগরকান্দা উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের উঠান বৈঠকের মাধ্যমে এ জেলার আয়োজন শেষ হয়। এতে গ্রামের অন্যান্য নারীর সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন রুবিনা আক্তারও।
উঠান বৈঠক থেকে নতুন কী শিখলেন? জানতে চাইলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রুবিনা বলেন, ‘আমি এখন আমার ব্যবসায়িক কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করব। ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দেব। কেমন ধরনের পোশাক আমি তৈরি করি, সেগুলোর ছবি দেব। আশা করি এতে অনেক কাজ পাব এবং আমার ব্যবসারও প্রসার ঘটবে।’
রুবিনা আক্তারের মতো বহু নারী উঠান বৈঠক শেষে এমন অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তেমনই একজন ঘোষপুর ইউনিয়নের উঠান বৈঠকে আসা বালিয়াপাড়া গ্রামের স্বপ্না আক্তার (২৫)। গত ১৯ অক্টোবর এ আয়োজনে অংশ নেন তিনি। স্বপ্না বলেন, ‘এখানে এসে নতুন অনেক কিছু শিখতে পেরে আমার খুব ভালো লেগেছে। বিশেষ করে শিশু ও নারীদের স্বাস্থ্য নিয়ে বিভিন্ন বিষয় শিখিয়েছে। এটা আমাদের অনেক কাজে দেবে।’
১৫ অক্টোবর আলফাডাঙ্গা উপজেলার বুরাইচ ইউনিয়নে সম্পন্ন হয় উঠান বৈঠক। সেখানে অংশ নেন বারানকুলা গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষার্থী রাফিজা আক্তার (১৭)। অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অনুষ্ঠানে আইসা অনেক কিছু শিখতে পারছি। বিশেষ করে নারীর রক্তশূন্যতাজনিত সমস্যা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি। যা আমার আগে জানা ছিল না।’
ফরিদপুর জেলায় উঠান বৈঠকের কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন ফরিদপুর বন্ধুসভার পাঁচ সদস্যের একটি দল। তাঁরা হলেন তৃষা দাস, বীথি সাহা, সুব্রত পাল, সুজীব দত্ত এবং দলনেতা লক্ষ্মণ চন্দ্র মণ্ডল। অনুষ্ঠান শুরু আগে জেলার ৫৬টি ইউনিয়ন ঘুরে স্থানীয় সহায়তাকারী নির্বাচন এবং জায়গা নির্ধারণের কাজ করা হয়। এ কাজে অন্য সদস্যদের সঙ্গে সহায়তা করেন বন্ধুসভার সদস্য শুভ কুমার বিশ্বাস ও পরশ সাহা।
দলনেতা লক্ষ্মণ চন্দ্র মণ্ডল বলেন, ‘আমাদের কাছে এটি ছিল নতুন ধরনের একটি কাজ, নতুন অভিজ্ঞতা। প্রথম দিকে কাজ কীভাবে সম্পন্ন করব, এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে ছিল অনেক ভাবনা। তবে যতই দিন গড়িয়েছে, কাজগুলো আমাদের হাতের মুঠোয় চলে আসে। পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ নারীদের সঙ্গে কাজ করার সময়টা দারুণ আনন্দে কাটে।’
দলের নারীকর্মী তৃষা দাস অধিকাংশ উঠান বৈঠকে উপস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, ‘একসঙ্গে এত মানুষের সামনে কথা বলার এমন সুযোগ আগে কখনো পাইনি। শুরুতে একটু জটিল মনে হলেও দুদিন কাজ করার পর থেকেই বেশ উপভোগ করেছি। ফরিদপুরের ৫৬টি উঠান বৈঠক শেষে দিনগুলোর স্মৃতিরোমন্থন করতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেছে।’
‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক প্রচারাভিযানটি অসংখ্য গ্রামীণ নারীর জীবনে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখার মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা চলার পথের ছোটখাটো সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে পারছেন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নে চলছে উঠান বৈঠক। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির আওতায় গতকাল শনিবার (১৬ নভেম্বর) পর্যন্ত ১ হাজার ৬৩৯টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে। আয়োজনটির সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক।