সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পরিদর্শনে সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন লিমিটেড কারখানায় নানা ধরনের ঘাটতি ধরা পড়েছিল প্রায় ১৪ মাস আগে। বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ডের (বিডা) নেতৃত্বে সরকারের নয়টি সংস্থার প্রতিনিধিদল তখন কারখানাটি পরিদর্শন করেছিল। পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈদ্যুতিক, অগ্নি, অবকাঠামো, পরিবেশ ও বিস্ফোরণ–সংক্রান্ত—এই পাঁচ ক্যাটাগরিতে (শ্রেণি) কারখানাটিতে নিরাপত্তায় ঘাটতি ছিল। আর এখন বিস্ফোরণের পর জানা গেল, কারখানাটি চলছিল মাত্র দুজন ডিপ্লোমাধারী (প্রকৌশলে ডিপ্লোমা ডিগ্রি) জনবল দিয়ে।
২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর সীমা অক্সিজেন কারখানা পরিদর্শন করে বিডার প্রতিনিধিদল। পরিদর্শনে কারখানার ত্রুটি চিহ্নিত করে কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয় গত বছরের ৩০ মার্চ। মূলত ২০২১ সালের জুলাই মাসে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুডস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সরকার সারা দেশে কলকারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে প্রধান করে গঠন করা হয় জাতীয় কমিটি। বিডার নেতৃত্বে কারখানা পরিদর্শনের জন্য উপকমিটি গঠন করা হয়। কমিটি যে পাঁচ হাজার কারখানা পরিদর্শন করে, সীমা অক্সিজেন লিমিটেড ছিল তারই একটি।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে সীমা কারখানায় বিস্ফোরণজনিত নিরাপত্তায় ঘাটতি থাকার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া কারখানায় অক্সিজেন সংরক্ষণ, পরিবহন ও স্থানান্তর এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্পর্কে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঠিক ধারণা না থাকার কথাও বলা হয়েছে। পাশাপাশি নিরাপদে কারখানা পরিচালনার জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণে ঘাটতি এবং মজুদাগার এলাকায় নিরাপত্তাবিষয়ক সতর্কতামূলক নির্দেশনা পুরোপুরি মানা হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত শনিবার বিকেলে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কদমরসুল এলাকায় সীমা অক্সিজেন কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সাতজন মারা গেছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন ২৪ জন। বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল কারখানার আশপাশের অন্তত এক বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিচ্ছিন্ন লোহার টুকরা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বিস্ফোরণস্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূর পর্যন্ত উড়ে যায় লোহার পাত।
পরিদর্শনে যেসব ঘাটতি
কারখানায় বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার ১৪টি বিষয়ের মধ্যে ৭টিই মানা হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে সনদপ্রাপ্ত ব্যক্তির তদারকিতে বৈদ্যুতিক কাজ সম্পন্ন না হওয়া, দুর্ঘটনারোধে কোনো সার্কিট বা যন্ত্রপাতিগুলো বিন্যস্ত না করা, লাইসেন্সধারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দিয়ে বৈদ্যুতিক তার পরীক্ষা না করা ইত্যাদি।
অগ্নিনিরাপত্তা ক্যাটাগরির ২২টি শর্তের ১০টি মানা হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে ফায়ার হাইড্রেন্ট (পানি সরবরাহের উৎস), ধোঁয়া শনাক্তকরণ যন্ত্র, অগ্নিপ্রতিরোধী ফলস সিলিং বা ছাদ, ফায়ার সেইফটি প্ল্যান না থাকা। শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ ও ব্যবহারের বিষয়টি পরিপূর্ণভাবে পালন না করা। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ফায়ার সার্ভিসের ‘ফায়ার সেইফটি প্ল্যানের’ (অগ্নিনিরাপত্তার ঝুঁকি কমাতে পরিকল্পনা) জন্য আবেদন করেছিল কারখানাটি। এটি এখনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি বলে ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান।
এই কারখানায় বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়াসহ পরিবেশগত নিরাপত্তার পাঁচটি বিষয় পুরোপুরি মানা হয়নি বলে পরিদর্শন প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে সার্বিক দুর্ঘটনারোধ এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ পরিস্থিতির মান নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাতে অবকাঠামো, অগ্নি, বৈদ্যুতিক, যন্ত্রপাতি, বিস্ফোরণ–সংক্রান্ত ও পরিবেশগত নিরাপত্তায় মোট ১০২ নম্বরের মধ্যে ৪৮ নম্বর পেয়েছে কারখানাটি, যা মোট মানের ৪৭ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সীমা অক্সিজেন কারখানার জন্য নয়টি সংস্থার সনদ বা লাইসেন্স নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এর মধ্যে বিস্ফোরক পরিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশসহ ছয়টি সংস্থার লাইসেন্স রয়েছে কারখানাটির। তবে বৈদ্যুতিক অনুমোদনপত্র, বিদ্যুৎ সরবরাহকারী ও সরকার অনুমোদিত বৈদ্যুতিক ঠিকাদার দিয়ে বৈদ্যুতিক পরীক্ষার সনদ ছিল না কারখানাটির।
পরিদর্শন–পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে কারখানা পরিদর্শনসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও বিডার নির্বাহী সদস্য অভিজিৎ চৌধুরী গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সীমা অক্সিজেনসহ প্রথম দফায় ৫ হাজার ২০৬টি কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছিল। এসব কারখানার পরিদর্শন প্রতিবেদন জাতীয় কমিটির কাছে দাখিল করা হয়েছে। কমিটির সভাও হয়েছে। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ত্রুটি সংশোধনের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
কারখানা চালাতেন দুজন ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী
অক্সিজেন কারখানা পরিচালনার জন্য দরকার কেমিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল প্রকৌশলী। দেশে যেসব বড় অক্সিজেন কারখানা রয়েছে, সেগুলোতে এই তিন শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রকৌশলী রয়েছেন। ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী ও টেকনিশিয়ান (কারিগরি কর্মী) রয়েছেন। তবে স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধানে তাঁরা কাজ করেন।
সীমা অক্সিজেন লিমিটেড কারখানায় দক্ষ জনবল ছিল না। কারখানা চালাতেন দুজন ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী। এই তথ্য কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মামুন উদ্দিন গতকাল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসনের সভায় নিজেই দিয়েছেন। তবে তিনি দাবি করেন, সব ধরনের লাইসেন্স নিয়ে তাঁরা কারখানার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। ঠিক কী কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা এখনো তাঁরা জানেন না।
ত্রুটি পেয়েছিল কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরও
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরও গত বছর ডিসেম্বরে সীমা কারখানা পরিদর্শনে বেশ কিছু ত্রুটি পেয়েছিল। অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপমহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল সাকিব গতকাল জেলা প্রশাসনের সভায় জানিয়েছেন, ‘পরিদর্শন করে আমরা অনেকগুলো সমস্যা পেয়েছিলাম। তাঁদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে পরিদর্শন করে চিঠি দেওয়া হয়। তাঁরা কিছু বিষয়ে সংশোধন করেছেন। আর কিছু সংশোধন করতে তিন মাস সময় চেয়েছিলেন। চলতি মাসের মাঝামাঝিতে ফলোআপ পরিদর্শন করার কথা ছিল।’
তবে এর আগেই গত শনিবার কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি সংস্থাগুলোর পরিদর্শনের পর বিভিন্ন কারখানায় যেসব সমস্যা পাওয়া গেছে, তা মানার জন্য উদ্যোক্তাদের বাধ্য করা দরকার। শিল্পকারখানার নিরাপত্তায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে উদ্যোক্তাদের। অক্সিজেন কারখানা পরিচালনা বা তত্ত্বাবধানের জন্য দেশে স্নাতক ডিগ্রিধারী জনবল রয়েছে। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল যদি কারখানা পরিচালনায় না থাকে, তাহলে ঝুঁকির মাত্রা বেশি হয়। দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন নতুন কারখানা হচ্ছে।
চুয়েটের এই শিক্ষকের মতে, কারখানার নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হেলাফেলা করার কোনো সুযোগ নেই। এ জন্য সরকারের তদারকি ব্যবস্থা দ্রুত ও জোরদার করা দরকার। না হলে ভবিষ্যতে আরও চরম মূল্য দিতে হবে।