বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামী রোগীদের ৫৩ শতাংশ বিদেশ যান মূলত রোগনির্ণয় বা চেকআপের জন্য। যত রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশ যান তার ৫ শতাংশ চিকিৎসক। চিকিৎসার জন্য বিশ্বের যেসব দেশের মানুষ বিদেশে বেশি যায় সেই তালিকার দশম স্থানে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের মানুষের বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার এই তথ্য শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। ‘চিকিৎসাসেবায় বিদেশমুখিতা: আমাদের উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এই বৈঠক আয়োজন করে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ এসোসিয়েশন। অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বলেন, দেশের রোগীদের বিদেশ যাওয়া ঠেকাতে সরকার পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে।
দেশের রোগীদের একটি অংশ বিদেশে, বিশেষত ভারতে চিকিৎসা নিতে যান। বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ও ভিসা জটিলতার কারণে রোগীদের ভারতে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় নির্ধারণে এই বৈঠক ডাকা হয়েছে বলে আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়। একাধিক আলোচক বলেন, বর্তমান সমস্যা সমাধানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ চিকিৎসাক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারবে।
অনুষ্ঠানে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের পরিচালক, নির্বাহী প্রধান ও জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকেরা অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের অধিকাংশের মত, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় আস্থা না থাকার কারণে মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। আস্থা ফিরিয়ে আনতে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে মালয়েশিয়ায় চিকিৎসা নিতে বিদেশি রোগী সবচেয়ে বেশি যান। অন্য ৯টি দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, দুবাই, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাইওয়ান, জার্মানি, মেক্সিকো ও তুরস্ক। অন্যদিকে যেসব দেশ থেকে বেশি রোগী অন্য দেশে যায় এমন ১০টি দেশের মধ্যে শীর্ষ আছে ইন্দোনেশিয়া। এই তালিকার ১০ নম্বরে আছে বাংলাদেশ। অন্য দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইতালি, জার্মানি, লেসেতো, দুবাই ও লিবিয়া।
অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী আহমদ এহসানূর রহমান। তিনি বলেন, বিদেশমুখী রোগীদের ৫১ শতাংশ যায় ভারতে। থাইল্যান্ডে যায় ২০ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে যায় ২০ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে রোগী যাওয়ার হার ৩ শতাংশ। ২ শতাংশ করে যায় জাপান ও মালয়েশিয়ায়। ১ শতাংশ করে যায় চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
ভারতে মূলত ১১টি এলাকায় বাংলাদেশি রোগী চিকিৎসা নিতে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যায় পশ্চিমবঙ্গে, তথা কলকাতায়। এরপর সবচেয়ে বেশি যায় দিল্লি ও তার আশপাশে। এরপর বেশি রোগীর পছন্দ হায়দরাবাদ। অন্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে—মুম্বাই, চেন্নাই ও বেঙ্গালুরু। কিছু রোগী আসাম, গুজরাট, লক্ষ্ণৌ ও রাঁচিতে যান।
কারা ভারতে চিকিৎসা নিতে যান তার একটি তালিকা তুলে ধরেন আহমদ এহসানূর রহমান। তালিকার শুরুতে আছেন ব্যবসায়ীরা, দ্বিতীয় স্থানে বেসরকারি চাকরিজীবীরা। তৃতীয় স্থানে আছেন দিনমজুরেরা। এরপর ক্রমানুসারে আছে যথাক্রমে সরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষক ও গৃহিণী। তার পরেই চিকিৎসকেরা। বিদেশগামী রোগীদের ৫ শতাংশ চিকিৎসক। অন্য উল্লেখযোগ্য পেশার মধ্যে আছেন সাংবাদিক, পুলিশ, শিক্ষার্থী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য।
আটটি দেশে যাওয়া রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিদেশে মানুষ মূলত রোগনির্ণয় বা চেকআপের জন্য বেশি যায়। তবে ভারতে মোট ২০টির বেশি কারণে বাংলাদেশি রোগীরা চিকিৎসা নিতে যান বলে মূল উপস্থাপনায় উল্লেখ করা হয়। সবচেয়ে বেশি মানুষ যায় হৃদ্যন্ত্র সংশ্লিষ্ট অস্ত্রোপচারের উদ্দেশ্যে। এর পরের কারণটি হচ্ছে, চোখের ছানিজনিত অস্ত্রোপচার। তৃতীয় ও চতুর্থ বড় কারণ যথাক্রমে কিডনি রোগ ও ক্যানসার।
দিনমজুরদের বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ আবদুস সবুর বলেন, দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের ঢাকায় চিকিৎসা করানোর চেয়ে ভারতে যাওয়া সাশ্রয়ী।
বেশ কয়েক বছর ধরে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে হৃদ্রোগ চিকিৎসায় উন্নতি হয়েছে। কিন্তু ভারতে সবচেয়ে বেশি রোগী যায় হৃদ্রোগের অস্ত্রোপচারে। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নাজমুল হোসেন বলেন, স্বাস্থ্য খাতে পুঁজির বিনিয়োগ ঠিকমতো হয়নি, বিনিয়োগ হয়েছে ঢাকাকেন্দ্রিক। তিনি বলেন, দেশে হৃদ্রোগে আক্রান্ত মানুষ অনেক বেশি। সারা দেশে ৩৪টি কেন্দ্রে হৃদ্রোগের অস্ত্রোপচার হয়, এর মধ্যে ২৬টি কেন্দ্রই ঢাকা শহরে। দেশের ৯৫ শতাংশ অস্ত্রোপচার হয় ঢাকায়। সারা দেশে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা থাকলে পরিস্থিতি এমন হতো না।
মুক্ত আলোচনায় অংশ নেওয়া অধিকাংশ বক্তার মন্তব্য ছিল, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কম। তবে এই আস্থাহীনতার জন্য এককভাবে কেউ দায়ী নয়। কিছু ক্ষেত্রে অপপ্রচারের কারণে অনাস্থা তৈরি হয়েছে।
# বিদেশমুখী রোগীদের ৫১ শতাংশ যান ভারতে।# থাইল্যান্ডে যান ২০ শতাংশ।# সিঙ্গাপুরে যান ২০ শতাংশ।# যুক্তরাজ্যে রোগী যাওয়ার হার ৩ শতাংশ।# ২ শতাংশ করে যান জাপান ও মালয়েশিয়ায়।# ১ শতাংশ করে যান চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
অনুষ্ঠানে যোগ দিতে খুলনা থেকে এসেছিলেন গাজী মেডিকেল কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাজী মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দক্ষ চিকিৎসক ও জনবল নেই। এখানে নানা দুর্ঘটনা ঘটে, আর দুর্নাম হয় পুরো স্বাস্থ্য খাতের।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সহসভাপতি অধ্যাপক জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেন, দেশে অনেক ক্ষেত্রে রোগ পরীক্ষা ঠিক হয় না, টাকা অনেক বেশি নেওয়া হয় এবং সেবাদানকারীদের ব্যবহার ভালো না।
মেডিকেল অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক হুমায়ুন কবির বলেন, ভারতের সিএমসি ভেলোর, টাটা মেমোরিয়াল বা শংকর নেত্রালয়ের ব্র্যান্ডিং এমনভাবে করা হয়েছে যে মানুষ নাম শুনে সেখানে যায়। ওই পর্যায়ে যেতে গেলে দরকার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, নীতি ও কৌশল।
মূল উপস্থাপনায় আহমদ এহসানূর রহমান বলেন, থাইল্যান্ড, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়ার সরকার অন্য দেশের রোগীদের জন্য নানা নীতি ও কৌশল অবলম্বন করেছে। থাইল্যান্ড বিদেশি রোগীদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা চালু করেছে। তারা প্রাথমিক অনুসন্ধান থেকে শুরু করে চিকিৎসার পরও রোগীকে নানা সহায়তা দেয়। ভারত এটা প্রচার করেছে যে ভারত বৈশ্বিক চিকিৎসার একটি বড় কেন্দ্র। তাদের নানা ধরনের বাজারজাতকরণ কৌশল আছে।
ভারতে এখন রোগী যেতে পারছেন না বা রোগী যেতে সমস্যা হচ্ছে, এটাকে কেউ কেউ ইতিবাচক বলে বর্ণনা করেছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ বলেন, ‘ভারত ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে, এবার আমরা ঠেকে শিখব। ভারত থেকে গরু না আসায় আমরা গরুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছি।’
একাধিক আলোচক বলেন, গণমাধ্যমের কারণে অনেক সময় দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা গড়ে ওঠে। তাঁরা ইতিবাচক খবর বেশি প্রচার করার আহ্বান জানান। কেউ কেউ দক্ষ জনবল গড়ে তোলার, কেউ চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সদাচরণে পারদর্শী করে তোলার পরামর্শ দেন। কেউ কেউ বলেন, রোগনির্ণয় ব্যবস্থা নিখুঁত না হলে রোগী সন্তুষ্ট হবেন না, তাঁদের আস্থা বাড়বে না।
‘আস্থার সংকট দূর করা জরুরি’—এমন মন্তব্য করে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের সচিব সারোয়ার বারী বলেন, অনেকে বিদেশে বেড়াতে গিয়ে কিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে আসেন, আবার অনেকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাজার করে আসেন। অর্থাৎ বিষয়টির সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক আছে। ওষুধের দাম যেন কমে আসে, সে ব্যাপারে সরকার গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। কর কমানোর বিষয়টিও সরকার সক্রিয়ভাবে চিন্তা করছে। এতে চিকিৎসা ব্যয় কমবে।
সরকার ইতিমধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নাজমুল হোসেন। তিনি বলেন, ঢাকার বাইরে উত্তরবঙ্গসহ ছয়টি স্থানে হৃদ্রোগ চিকিৎসার মানসম্পন্ন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। এ ছাড়া খুলনা, সিলেট, বগুড়া ও চট্টগ্রামে ভাসকুলার সার্জারি কেন্দ্র গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তিন ঘণ্টার এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ এসোসিয়েশনের সভাপতি এম এ মুবিন খান। অনুষ্ঠানের শুরুতে ও শেষে তিনি বলেন, সরকারের পাশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আছে। হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করলে, বিদেশে রোগী কম যাবে।